নিজস্ব প্রতিনিধিঃ প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ডের ঐতিহাসিক শহর কিলকেনিতে গত ২৩শে মে ২০২২ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো গ্রেটার মৌলভীবাজার এসোসিয়েশনের ঈদ পুনর্মিলনী। স্থানীয় “সেইন্ট কানিসেস নাইবারহুড” হলে অনুষ্ঠিত এই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের কিছুটা দেরীতে শুরু হলেও অতিথি সমাগম ছিল লক্ষণীয়। দীর্ঘ কোভিড মহামারির পর এই পুনর্মিলনি অনুষ্ঠানে জাকজমকপূর্ন পোশাকে প্রবাসী শিশু, কিশোর এবং নারী পুরুষের অংশগ্রহণ এবং সৌহার্দ বিনিময় হৃদ্যতাপূর্ন এবং আনন্দমুখর ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। অনেকেই দীর্ঘদিন পর একে অন্যকে দেখে আনন্দিত হয়েছেন, হাতে হাত মিলিয়েছেন, বুকে বুক ও মিলিয়েছেন।
অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মুহিত এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সাইয়েদ আতিকুর রব শাহি। শুরুতে পবিত্র কোরানের সুরা বাকারার ১৫৩-১৫৭ নাম্বার আয়াত অর্থ সহ পাঠ করেন হাফিজ মৌলানা আব্দুল জলিল। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবশনকালে সকলেই দাঁড়িয়ে অংশগ্রহণ করেন। সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুল মুহিত বিগত দেড় বছরের গৃহীত কার্য্যক্রম উপস্থিত সকলের সামনে তুলে ধরেন, এর মধ্যে বাংলাদেশে গরিবদের মধ্যে প্রায় ১০লক্ষ টাকা মূল্যের কাপড় ও খাদ্যদ্রব্য বিতরণ অন্যতম। এছাড়াও সংগঠনের পক্ষ থেকে, জনাব মুহিতের নিজস্ব পৃষ্ঠপোষকতায় ১৬০ জন শিশু কিশোরের জন্য একমাসব্যাপি নামাজ এবং কোরান শিক্ষা কর্মশালা সম্পন্ন করা হয়েছে। আগামীতে মৌলভীবাজারের প্রতিটি উপজেলায় এই ধরনের কর্মশালা আয়োজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানানো হয়।
সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব শাকিল আহমেদ চৌধুরী মৌলভীবাজারের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, মৌলভী সৈয়দ কুদরতুল্লাহ নামের একজন বিচারক ও স্থানীয় জমিদার তার নিজস্ব জমিতে ১৭৭১ সালে একটি বাজার স্থাপন করলে, কালে এই শহর মৌলভিবাজার হিসাবে পরিচিত পায়। মৌলভী সৈয়দ কুতুবুল্লাহ ছিলেন, অত্র অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের অগ্রদূত শাহ মোস্তফা বোগদাদির বংশধর। মৌলভীবাজারে জনাব শাহ মোস্তফা বোগদাদির মাজার এখনো দর্শনার্থিদের জন্য গুরুত্ত্বপূর্ন। প্রচলিত তথ্য অনুসারে শাহ মোস্তাফা বোগদাদী ছিলেন বড়পীর নামে সমধিক পরিচিত আব্দুর কাদের জিলানী (রঃ আঃ) র বংশধর। বাংলাদেশে মৌলভীবাজারের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন দেশে ১৫১ টি চা বাগানের মধ্যে ৯১টি এই জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের আগর, আনারস, বাঁশ, কাঁঠাল, আম এবং রাবারের গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ এই অঞ্চলেই উৎপন্ন হয়ে থাকে। হাকালুকি, হাইল এবং বিলাশছড়া হাওর সারা দেশের পরিবেশ রক্ষ্যায় অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ভ্রমণকারিদের নিকট অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। মৌলভীবাজার বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছে এটা সর্বজনবিদিত।
গ্রেটার মৌলভীবাজার এসোসিয়েশন, আয়ারল্যান্ডের কার্য্যনির্বাহী পরিষদের সভাপতি থার্লেস নিবাসী গোলাম নবী বাবুল, সহসভাপতি লিটারকেনি নিবাসী আব্দুস সহিদ, সাধারণ সম্পাদক ক্লনমেল নিবাসী আব্দুল মুহিত, সহ-সাধারণ সম্পাদক ক্লোনমেল নিবাসী আনোয়ারুল হক তরফদার, অর্থ সম্পাদক জনাব রাব্বি খান, প্রচার সম্পাদক নুরুল ইসলাম, এবং মহিলা সম্পাদিকা সৈয়দা শাহনাজ বেগম এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক সাইদ আহমেদকে অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেন আতিকুর রব শাহি।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে এসোসিয়েশনের পরিচিতি এবং প্রতিবেদনের পর, আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা বৃহত্তর মৌলভিবাজার এসোসয়েশনের গৃহীত কার্য্যক্রমের প্রশংসা করেন।
ডাবলিন থেকে আগত জনাব আব্দুল জ্বলিল, সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে এসোসিয়েশনের উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং ভবিষ্যতে ভালো কাজের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
বাংলাদেশ স্পোর্টস এসোসিয়েশন অব আয়ারল্যান্ডের (বি এস এ আই) সভাপতি জনাব চুন্নু মাতুব্বর সকলকে খেলাধুলায় অংশগ্রহণের জন্য বি এস এ আই এর বিভিন্ন কার্য্যক্রমের সাথে নিজেদের এবং নিজেদের সন্তানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান। তিনি বলেন, “আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতন হওয়ার এখনই সময়। বি এস এ আই এই কার্য্যক্রমে আপনাদের পাশে থাকবে।”
অল বাংলাদেশী এসোসিয়েশন অফ আয়ারল্যান্ডের (আবাই) সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আনোয়ারুল হক, এই ঈদ পুনর্মিলনি আয়োজনের জন্য উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানান এবং ভবিষ্যৎ সকল কার্য্যক্রমে তার সহায়তার আশ্বাস প্রদান করেন। মৌলভীবাজারের সাথে তার এক গভীর আত্নিক সম্পর্কের কথাও প্রকাশিত হয়।
বি ডি সি ফুডসের পরিচালক জনাব সাইয়েদ রিদোয়ান আহমেদ সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং এসোসিয়েশনের কার্য্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অঙ্গীকার ব্যাক্ত করেন।
আয়ারল্যান্ড বি এন পির সদ্য বিদায়ী সভাপতি জনাব হামিদুল নাসির তার বক্তব্যে বলেন, “জেলাভিত্তিক সংগঠনের কার্য্যক্রম যেন আমাদের বিভক্ত না করে দেয় বরং সমন্বিত কার্য্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে আমরা সকলে এই প্রবাসে যেন দ্রুত আত্নীকৃত হয়ে যেতে পারি, সেই লক্ষ্যে কার্য্যক্রম গ্রহণ করা উচিৎ। আমরা আমাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করেই আয়ারল্যান্ডের সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে। বিশেষ করে আগামী প্রজন্মকে মূলধারায় আত্নীকৃত করায় অভিভাবক হিসাবে আমাদের দায়িত্ব অপরিসীম।”
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব আয়ারল্যান্ড (বাই) এর প্রাক্তন সভাপতি জনাব সাইয়েদ মুস্তাফিজুর রহমান কিলকেনীতে সকলকে স্বাগত জানিয়ে, উপস্থিত সকলকে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান।
ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদার বৃহত্তর মৌলভীবাজার এসোসিয়েশনের সমাজসেবামূলক কার্য্যক্রমের প্রশংসা করেন। নারী এবং পুরুষদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আমাদের পরিবারের পরিসর বাড়ছে, সন্তান-সন্ততিরা ইউরোপের মাটিতে বড় হয়ে উঠছে। পিতামাতা হিসাবে ইউরোপের মাটিতে আমাদের সন্তানদের ভালো মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হলে জানতে হবে তা কিভাবে সম্ভব। শুধুমাত্র ভালো পিতামাতা হলেই চলবেনা আমাদের নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আত্নিক উন্নয়নে ধর্ম সহ নীতি-নৈতিকতা বোধকে প্রাধান্য দেয়া গুরুত্ত্বপূর্ন”। তিনি বলেন, অতীতে “গুড পেরেন্টিং” এবং “আত্নিক উন্নয়নে” এর উপর কর্মশালা করা হয়েছে, সেগুলো মূলত ডাবলিন ভিত্তিক ছিল। বৃহত্তর মৌলভীবাজার এসোসিয়েশন এই কাজে গুরুত্ত্বপুর্ন ভূমিকা রাখতে পারে। উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সর্বাত্নক সহযোগিতার কথা তিনি সবাইকে অবগত করেন।”
কিলকেনি থেকে সুপরিচিত জনাব কামাল হোসেন সোর্ডস মসজিদের জন্য অর্থ সহায়তা প্রদানের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে বক্তব্য করে জানান যে মসজিদের জন্য অর্থ প্রদান আমাদের সকলের দায়িত্ব এবং এর ভবিষ্যতের অন্তহীন জীবনে সুখ এবং আনন্দের জন্য এই দান গুরুত্ত্বপূর্ন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল ভোজন পর্ব। সকল অতিথিদের জন্য সুস্বাদু পোলাও, মুরগির কুর্মা, মাংস ভুনা, কেক ও মৃদু পানীয় পরিবেশন করা হয়।
অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আক্ররষনীয় পর্ব ছিল শিশু কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। বেশ কিছু শিশু এই চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। সকল শিশুদের চিত্রাঙ্কনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল বাংলাদেশ এবং ঈদ। প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকারীকে আকর্ষণীয় পুরষ্কার প্রদান করা হয়। একই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিগত অনুষ্ঠানে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতায় বিজয়ীদেরও পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
তৃতীয় পর্বে ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে মূল শিল্পী ছিলেন কর্ক থেকে আগত স্বনামধন্য সংগীত শিল্পী অজিতাভ রায় অভি। তার পরিবেশিত প্রথম সংগীত “ধন্যধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধুরা” এই প্রবাসে সকলের মনে জন্মভূমির জন্য নস্টালজিয়ার একটি আবহ সৃষ্টি করে দেয়। এরপর ধীরে ধীরে তিনি বেশ কয়েকটি সংগীত পরিবেশন করে দর্শকদের মোহিত করেন। এছাড়াও ডাবলিন থেকে রুনা জলিল এবং লাকি আহমেদ দুটি করে সংগীত পরিবেশন করেন।