আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ সরকার নির্ধারিত মূল্যে কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা। সরকার নির্ধারিত মূল্যে ট্যানারি মালিকরা চামড়া না কেনায় নামমাত্র মূল্যে চামড়া কিনে আড়তদাররাও মোটা অংকের লোকসান গুনতে বাধ্য হচ্ছেন। পাওনা টাকা না পেয়ে ব্যবসায়ীদের অনেকেই পেশা বদল করছেন। কাঁচা চামড়া সংগ্রহে নগদ অর্থসংকটে হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে চামড়া শিল্পের ভবিষ্যত। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে ডেস্ক রিপোর্ট–
টাঙ্গাইল: চামড়া নিচ্ছেন না ট্যানারি মালিকরা
সরকারিভাবে বেঁধে দেওয়া তারিখ অনুযায়ী শনিবার (১৭ আগস্ট) সকাল থেকে লবণযুক্ত চামড়া রফতানির লক্ষ্যে ট্যানারি মালিকদের চামড়া ক্রয় করার কথা থাকলেও, ওই দিন বিকেল পর্যন্ত টাঙ্গাইলে চামড়া নিতে আসেননি তারা। জেলা পর্যায়ের আড়তদার ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে চামড়া শিল্প হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। চামড়া ব্যবসায়ীরদের পাওনা টাকা না দেওয়ায় এখন সর্বস্বান্ত মৌসুমী ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। ধার-দেনা করে ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা চামড়া কিনলেও ট্যানারি মালিকরা তা তাদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন না। ফলে, একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হচ্ছে; অন্যদিকে সনাতন প্রথানুযায়ী চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থ দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও এতিম মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ না হওয়ায় তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।
চট্টগ্রাম: নষ্ট হয়েছে ৩০ শতাংশ চামড়া
চট্টগ্রামে চলতি বছর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ গরু ও মহিষের চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও সংগ্রহ করা হয় প্রায় চার লাখ। শতাংশের হিসেবে তা প্রায় ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে। সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও ট্যানারি মালিকদের ইচ্ছেমতো দর নির্ধারণ করে চামড়া ক্রয়ের ফলে এবং নগদ অর্থের সংকটে পড়ায় চামড়া সংগ্রহে অনীহা দেখিয়েছেন চট্টগ্রামের চামড়া আড়তদাররা। ফলে ব্যবসায়িক ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তায় অর্ধেক আড়তই এবার চামড়া সংগ্রহ করেনি। কোটি কোটি টাকার কাঁচা চামড়া সড়কে ফেলে রেখে চোখের জলে লোকসান গুনেছেন চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি চামড়া ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় এক লাখের বেশি নষ্ট চামড়া সরিয়ে নেয়। এভাবে চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় ও চামড়া নষ্ট হওয়ায় চামড়াজাত শিল্প ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম চামড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি আবদুল কাদের বলেন, ”আড়তগুলোর কাছে নগদ অর্থ নেই। ঢাকার অধিকাংশ ট্যানারি মালিক চামড়া নেওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা ফেরত দেন না। এমনিতেই ২০১৮ সালে সংগৃহীত চামড়ার মূল্য বাবদ প্রায় ৩০ কোটি টাকা বকেয়া আটকে রয়েছে। এ কারণে আমরা এবার চামড়া সংগ্রহ করতে পারিনি। ট্যানারি মালিকরা আশ্বস্ত করলে চামড়া শিল্পে নজিরবিহীন দরপতনের ঘটনা ঘটত না।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের একমাত্র চালু ট্যানারি রিফ লেদারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোকলেসুর রহমান বলেন, “বেশি দামে চামড়া সংগ্রহ না করার জন্য বিভিন্নভাবে চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও মৌসুমী ব্যবসায়ীসহ সবাইকে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেটা করেননি বলে তাদের লোকসান গুনতে হয়েছে।”
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম ভিন্ন একটি প্রেক্ষিত টেনে বললেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও চামড়া শিল্প পল্লী করার জন্য বলে আসছি। সেটা করা হলে চট্টগ্রামে এভাবে চামড়া নষ্ট হত না। ন্যায্য দাম পেতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্ত এবার চামড়া কম সংগ্রহ হওয়ায় এবং নষ্ট হওয়ার কারণে এ খাতের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ’
চট্টগ্রামের আড়তদার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রামে একসময় ২২টি ট্যানারি ছিল। কিন্তু অব্যাহত লোকসান ও নগদ অর্থসংকটে এসব ট্যানারির সিংহভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে দুটি ট্যানারি থাকলেও একটি ইটিপি না থাকায় পরিবেশ অধিদফতরের নিষেধাজ্ঞায় সেটি বন্ধ রয়েছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে কোরবানির ঈদে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ পশুর (ছাগল ও ভেড়া বাদে) চামড়া সংগ্রহ হয়।
খুলনা: পানির চেয়েও কম দামে চামড়া
খুলনায় এবার পানির চেয়েও কম মূল্যে বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। চামড়া বিক্রি করতে এসে অনেক বিক্রেতাকে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। নগরীর শেখপাড়ায় চামড়াপট্টিতে চামড়া বিক্রি করতে এসে হতাশা ও ক্ষোভের সঙ্গে নগরীর জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন মাদানীনগর মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলছিলেন, “ছয়টি গরুর চামড়া ৭শ’ টাকায় এবং সাতটি ছাগলের চামড়া বিক্রি করেছি মাত্র ১শ’ টাকায়। অনেক ধরাধরি করার পর ১৩টি চামড়ার মূল্য দিয়েছে মাত্র ৮শ’ টাকা। পানির চেয়েও সস্তায় বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। এতে চামড়া সংগ্রহের জন্য পরিশ্রম এবং বহনের জন্য রিকশা ভাড়াও ওঠেনি।”
তিনি বলেন, “মাদ্রাসার এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং পরিচালনার জন্য কোরবানির পশুর চামড়া একটি অন্যতম বড় মাধ্যম। এ চামড়া বিক্রির অর্থে এতিম ছাত্রদের বছরের বেশিরভাগ সময়ের খাবারের সংস্থান হয়। কিন্তু এবার চামড়ার মূল্য না থাকায় বড় ধরনের সংকটের আশংকা তৈরি হয়েছে।”
এদিকে, খুলনা অঞ্চলে ছাগলের চামড়ার কোনো দামই ছিল না। প্রতিটি ছাগলের চামড়া সর্বোচ্চ ৫-১০টাকায় বিক্রি হয়েছে। আবার কোনো কোনো ব্যবসায়ী ছাগলের চামড়া কিনতেই চাননি। যে কারণে অনেকেই ছাগলের চামড়া নদীতে ফেলে দিয়েছেন।
খুলনা শেখপাড়া চামড়া পট্টির আমান লেদারের মোহাম্মদ মুন্না জানালেন, তারা ঢাকার ট্যানারিতে চামড়া দিয়ে থাকেন। সেখানে তার ৪৭ লাখ টাকা বকেয়া ছিল। তিনি এবার মাত্র ৬শ’ পিস চামড়া কিনেছেন। আর মাত্র ২০ ভাগ মূল্য হাতে পেয়েছেন। যা দায়-দেনা পরিশোধেই খরচ হয়ে গেছে।
ফুলতলার সুপার ট্যানারির এমডি ফিরোজ ভুঁইয়া অবশ্য বললেন, ‘আমরা চেষ্টা করি চামড়ার যথাযথ দাম পরিশোধ করতে। চামড়ার দামও ১০-১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। এখানে মাদ্রাসা থেকে চামড়া আসার পর তা প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে।”
বগুড়া: পেশা বদলে ফেলছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা
ট্যানারি মালিকদের কাছে টাকা আটকে যাওয়ায় বগুড়ায় চামড়া ব্যবসায়ীদের অনেকেই পেশা বদল করে রিক্সা চালাতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ দিনমজুরের কাজে ঢুকে গেছেন। দীর্ঘদিন পাওনা টাকা না পেয়ে অনেকে আবার ঢাকায় প্রহরীর কাজও নিয়েছেন। চামড়া ব্যবসায়ী নেতারা এসব তথ্য দিয়ে আরও জানান, যারা এ ব্যবসায় টিকে আছেন তারাও মূলধনের অভাবে ব্যবসায় কত দিন টিকে থাকবেন বলা মুশকিল।
বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল হোসেন জানান, নগদ টাকায় কেনা কাঁচা চামড়া বাকিতে ঢাকায় ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে বিপাকে পড়েছেন জেলার চামড়া ব্যবসায়ীরা। ৩-৪ বছর ধরে ট্যানারি মালিকদের কাছে মোটা অংকের টাকা আটকে যাওয়ায় কেউ চালাচ্ছেন রিক্সা, কেউ-বা চাকরি করছেন নিরাপত্তাকর্মীর পদে। অনেকেই আবার দিনমজুরের কাজ করছেন।
বগুড়া শহরের চকসূত্রাপুর এলাকার ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ী নাসিম সর্দার কয়েক বছর আগেও চামড়া বেচাকেনা করতেন। আড়তদারদের মাধ্যমে ঢাকায় চামড়া বিক্রি করলে আটকে যায় তার বড় অংকের টাকা। অর্থসংকটে পড়ে এখন তিনি ব্যাটারিচালিত ত্রি-হুইলার চালাচ্ছেন বগুড়া শহরে। আরেক ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ী টি.এ সোহেল পুঁজি হারিয়ে প্রহরীর কাজ নিয়েছেন ঢাকায়। আর একই এলাকার আপেল মাহমুদ এখন কসমেটিকসের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন।
বরিশাল: সিন্ডিকেটভুক্ত ব্যবসায়ীদের শাস্তি দাবি
সরকার নির্ধারিত মূল্যের তোয়াক্কা না করে নামমাত্র মূল্যে চামড়া বিক্রয়ে জনগণকে বাধ্য করার প্রতিবাদে ও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের শাস্তির দাবিতে বুধবার দুপুরে বরিশাল নগরীতে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ বরিশাল জেলার উদ্যোগে এ কর্মসূচী পালিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাসদ বরিশাল জেলার সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, সরকার সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের পক্ষে দেশ পরিচালনা করছে। কৃষক যেমন সরকারি মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেননি, ঠিক তেমনি জনগণও সরকারি মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে পারছেন না। মাদ্রাসার এতিমখানায় দরিদ্র মানুষের সন্তানরা যে চামড়া বিক্রি করে কিছু অর্থের সংকুলান করতে পারত ব্যবসায়ীরা সে জায়গায়ও তাদের লোলুপ থাবা বসিয়ে দিয়েছে।