মাওলানা ফখরুল ইসলামঃ
বিনয় শব্দের অর্থ নম্রভাব, নম্রতা, কোমলতা, মিনতি প্রভৃতি। নম্রতা শব্দের অর্থ বিনীত, ঔদ্ধত্যহীন, নিরহংকার, অবনত, নরম, কোমল, শান্তশিষ্ট প্রভৃতি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) বলেছেন, ‘বিনয় ও নম্রতার মূল হলো- তুমি তোমার দুনিয়ার নেয়ামতের ক্ষেত্রে নিজেকে তোমার নিচের স্তরের লোকদের সঙ্গে রাখো, যাতে তুমি তাকে বোঝাতে পারো যে তোমার দুনিয়া নিয়ে তুমি তার চেয়ে মর্যাদাবান নও। আর নিজেকে উঁচু করে দেখাবে তোমার চেয়ে দুনিয়াবি নেয়ামত নিয়ে উঁচু ব্যক্তির কাছে, যাতে তুমি তাকে বোঝাতে পারো যে দুনিয়া নিয়ে সে তোমার ওপর মর্যাদাবান নয়।’
বিনয়-নম্রতার প্রকারভেদ
ক্ষেত্র বিবেচনায় বিনয় ও নম্রতাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো-
মানুষের সঙ্গে নম্রতা : মানুষের সঙ্গে আচার-আচরণে নম্রতা অবলম্বনের বিষয়ে মহান আল্লাহ তার রাসুলকে বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে। যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তাহলে তারা তোমার আশপাশ থেকে দূরে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদের ক্ষমা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। আর কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো…।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৫৯
চাকর বা অধীনদের সঙ্গে নম্রতা : চাকর-চাকরানী ও গৃহপরিচারিকার সঙ্গে সদাচরণ করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কারও খাদেম যখন তার খাবার নিয়ে আসে, তখন তাকে যদি সঙ্গে না বসায় তাহলে সে যেন তাকে এক লোকমা বা দুই লোকমা খাবার দেয়। কেননা সে তার গরম ও কষ্ট সহ্য করেছে।’ -সহিহ বোখারি : ৫৪৬০
জীবজন্তুর সঙ্গে নম্রতা : জীবজন্তু ও পশুপাখির সঙ্গেও নম্রতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হজরত হিশাম ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, আমি হজরত আনাস (রা.)-এর সঙ্গে হাকাম ইবনে আইয়ুবের কাছে গেলাম। তখন হজরত আনাস (রা.) দেখলেন, কয়েকটি বালক কিংবা বর্ণনাকারী বলেছেন, কয়েকজন তরুণ একটি মুরগি বেঁধে তার দিকে তীর ছুড়ছে। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘নবী কারিম (সা.) জীবজন্তুকে বেঁধে এভাবে তীর ছুড়তে নিষেধ করেছেন।’ -সহিহ বোখারি : ৫৫১৩
হজরত শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে আমি দুটি কথা মনে রেখেছি, তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের ওপর ‘ইহসান’ অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সঙ্গে হত্যা করবে, আর যখন জবাই করবে তখন দয়ার সঙ্গে জবাই করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার জবেহকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে।’ -সহিহ মুসলিম : ১৯৫৫
বিনয় ও নম্রতার গুরুত্ব
বিনয়ী হওয়ার নির্দেশ : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ধীরস্থিরতা ও নম্রতা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হও।’ -সুরা শুআরা : ২১৫
মহান আল্লাহ বিনয়ী মানুষদের প্রশংসায় বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহর বান্দা তো তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’…।’ -সুরা ফুরকান : ৬৩-৬৬
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এটা আখেরাতের নিবাস, যা আমি নির্ধারণ করি তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। মুত্তাকিদের জন্য আছে শুভ পরিণাম।’ -সুরা কাসাস : ৮৩
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তি নম্র ও ভদ্র হয়। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়।’ -জামে তিরমিজি : ১৯৬৪
অন্যত্র হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের জান্নাতি মানুষের সংবাদ দেব না? আর তারা হলো সরলতার দরুন দুর্বল প্রকৃতির লোক। মানুষ তাদের হীন, তুচ্ছ ও দুর্বল মনে করে। তারা কোনো বিষয়ে কসম করলে আল্লাহ তা সত্যে পরিণত করেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, আমি কি তোমাদের জাহান্নামিদের সংবাদ দেব না? আর তারা হলো- প্রত্যেক অনর্থক কথা নিয়ে ঝগড়াকারী বদমেজাজি ও অহংকারী।’ -সহিহ মুসলিম : ৫১০৬