তুরস্ক-গ্রিস দ্বন্দ্বে নূতন মাত্রা ( ভিডিও)

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদার – আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ গ্রীস এবং তুরস্ক আবারো যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে – এবারের  উত্তেজনার কারণ পূর্ব ভূমধ্যসাগরের নীচে বিশাল  প্রাকৃতিক গ্যাস ও সম্ভাব্য তেল মজুদের কর্তৃত্ত্ব। এই দুটি দেশ, ন্যাটো সদস্য হয়েও চিরায়ত প্রতিদ্বন্দ্বী, তারা ভূমধ্যসাগরে একে অপরের বিরোধিতায় তাদের নৌ ও যুদ্ধ বিমান পরিচালিত করেছে।

 সাইপ্রাস দ্বীপ নিয়ে এই দুই দেশের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। ১৯৬৩ সালে কার্য্যতঃ বিভক্ত হলেও ১৯৭৪ সালে এই দ্বীপের উত্তরের অংশ তুরস্ক দখলে নেয়, যদিও বিশ্ব সম্প্রদায় এই অধিকার এখনো মেনে নেয়নি। দক্ষিণের অংশ গ্রীক সাইপ্রিয়ট নামে পরিচিত সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃত রাষ্ট্র। 

এগিয়ান সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে গ্রীস ও তুরস্ক বিগত দুই দশকে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে  লিপ্ত হয়। ১৯৮৭ এবং ১৯৯৬ সালে ছোটখাটো  সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত না হলে তা বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারত।

এবারের বিরোধ অবশ্য ভিন্ন, ভূমধ্যসাগরের এই অঞ্চলে সম্ভাব্য বিশাল গ্যাস এবং তেল মজুদ নিয়েই দ্বন্দ্ব, সবাই এর অংশ চায়। ইতিমধ্যে কেউ কেউ এর অংশ পাচ্ছেন কিন্তু তুরস্ক এর অংশ থেকে বঞ্চিত। এই বিশাল গ্যাস ও সম্ভাব্য তেলের ভাণ্ডার, এই অঞ্চলের সকল দেশকে একত্রিত করে গ্যাস প্রাপ্তি এবং রফতানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা থাকলেও, ঐক্যের পরিবর্তে, হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের অধিকার অর্জন নিয়ে ইতিমধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
২০২০ সালে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যখন তুরস্ক সক্রিয়ভাবে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে, যেখানে ইসরায়েল, মিশর এবং সাইপ্রাস সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কার করেছে। সাইপ্রাসে সামুদ্রিক সীমানার বিরোধী ব্যাখ্যা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন থেকেই এই বিরোধগুলি উদ্ভূত হয়।

তুরস্ক গ্রীসের এই দাবি স্বীকৃতি দেয় না যে এর আঞ্চলিক অধিকারগুলি অনেকগুলি দ্বীপের অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত হয়, যার মধ্যে কিছু তুরস্কের উপকূলে রয়েছে। বরং তারা মনে করে এটি যুক্তিযুক্ত যে কোনও দেশের মহাদেশীয় শেল্ফটি এর মূল ভূখণ্ড থেকে পরিমাপ করা উচিত। সমুদ্র আইন সম্পর্কে জাতিসংঘের কনভেনশন অনুসারে উপকূলীয় দেশগুলি তাদের উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল (৩০০ কিলোমিটার) পর্যন্ত একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল বজায় রাখতে পারে যেখানে তারা ফিশিং, মাইনিং এবং ড্রিলিং অধিকারের অধিকারী। যেখানে দুটি  অঞ্চল পরস্পরের অংশ ছেদ করে সেখানে দেশগুলির মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছানো আবশ্যক। তবে তুরস্ক সম্মেলনটি অনুমোদন করেনি। এটি এমন অবস্থানও নিয়েছে যে সাইপ্রাসের মতো দ্বীপরাষ্ট্রগুলি কেবল তাদের আইনী আঞ্চলিক জলের মধ্যে অধিকারের অধিকারী, যা সর্বাধিক ১২ নটিক্যাল মাইল অবধি বিস্তৃত হতে পারে। এদিকে, স্ব-ঘোষিত তুর্কি সাইপ্রিয়ট রাষ্ট্র সাইপ্রিওট উপকূলে আবিষ্কৃত যে কোনও শক্তি সংস্থার অধিকার দাবি করে।

ভীডিওঃ আল জাজিরা টেলিভিশন

বিগত ১২ই আগস্ট সাইপ্রাস ও ক্রিটের মধ্যবর্তী বিতর্কিত সাগরে গ্রীক এবং তুরস্কের ফ্রিগেটের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তুরস্কের ফ্রিগেটটি, “ওরুক রিস” নামক তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানী জাহাজ বহনকারী পাঁচটির মধ্যে একটি ছিল। গ্রিস অবশ্য এই সংঘর্ষটিকে দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে, কিন্তু তুরস্ক এই সংঘর্ষকে ইচ্ছাকৃত উস্কানি হিসাবে মনে করে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঘোষণা করেন, “যদি এভাবে চলতে থাকে তবে আমরা প্রতিশোধ নেব।”

এটা সকলের অজানা নয় যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস রয়েছে এবং এর কিছু ইতিমধ্যে পাইপলাইনের মাধ্যমে মিশর ও ইসরায়েলে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, এতে করে তাদের জ্বালানি আমদানির ব্যয় কমছে আর কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ছে। ইতিহাস তুরস্ককে এই সুযোগ থেকে অনেকাংশে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আঞ্চলিক পানিসীমা, কন্টিনেটাল শেল্ভ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলির (ই ই জেড) মানচিত্রগুলি এমনভাবে আঁকা হয়েছে যার ফলে গ্রীস এবং তার মিত্র সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্র এই অঞ্চলের বিশাল ভাণ্ডারের সর্বাধিক প্রবেশাধিকার পেয়েছে। 

তুরস্কের বর্তমান স্থল ও সমুদ্রসীমা, ১৯২৩ সালের “লসান চুক্তির” ফলাফল, এই চুক্তি সেই সময়ে অটোমান সাম্রাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রীস এবং রোমানিয়ার মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধান দিয়েছিলো। দীর্ঘদিন থেকেই এরদোগান এই চুক্তি পুনর্বিবেচনার দাবী করে আসছেন, তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে এই চুক্তি পুনর্বিবেচনা না হলে তিনি ঝামেলা করবেন,  এটি ইতিমধ্যে ঘটছে।

গত নভেম্বরে, তুরস্ক জাতিসংঘ সমর্থিত লিবিয়া সরকারের সাথে একটি সামুদ্রিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির ফলে লিবিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূল থেকে তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় তীর অবধি একটি ই ই জেড প্রতিষ্ঠা করে। এই চুক্তির ফলে ক্রিটের কাছে গ্রীসের দাবীকৃত কিছু অংশ ছুরির মত কাটছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগর এবং নিকট মধ্য প্রাচ্যের বেশিরভাগ অংশ চিরকাল শক্তি-দরিদ্র অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেল ও গ্যাসের বিশাল সম্পদ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ইরান এবং ইরাকের অন্তর্ভুক্ত – এরা সকলেই আজকের ওপেকের সদস্য, তাদের কেউই ভূমধ্যসাগরীয় সীমান্তের সাথে নেই।

প্রায় এক দশক আগে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের অনুকূলে শক্তির ভারসাম্য সামান্য পরিবর্তন হতে শুরু করে, যখন টেক্সাসের “নোবেল এনার্জি” ইসরায়েলের উপকূলে গভীর জলের মধ্যে গ্যাসের মজুদ পায় এবং গত বছরের শেষ দিকে এই বিপুল লেভিয়াথান গ্যাস ক্ষেত্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। এর কিছুদিন পরই, গ্রীক ভাষী, সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্র, যার উত্তরের অর্ধেক তুরস্ক দাবি করেছে, সেখানেও গ্যাস পাওয়া গিয়েছিলো। বিশ্বব্যাপী তেল শিল্পের অন্যতম সাত “সুপার মেজর” হিসাবে বিবেচিত, ইতালীয় জাতীয় সংস্থা “এনি” ২০১৫ সালে মিশরের জোহর গ্যাস ক্ষেত্রটি আবিষ্কারের সাথে সাথে এই অঞ্চলের শক্তির সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয় এবং ২০১৭ সালে উৎপাদন শুরু হওয়া “জোহর” ভূমধ্যসাগরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় গ্যাস ক্ষেত্র।

আভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের ৯৮% গ্যাস তুরস্ককে আমদানি করতে হয়, যার বেশীর ভাগ তারা রাশিয়া এবং ইরান থেকে আমদানি করে আর কিছু তরল প্রাকৃতিক গ্যাস তারা আজারবাইজান থেকে আমদানি করে থাকে, যার ফলে তুরস্ক নিজস্ব মজুদ গ্যাসের জন্য মরীয়া।

রাশিয়া ও ইরানের সাথে তুরস্কের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে, এবং তুরস্ক নিজস্ব প্রতিযোগিতামূলক সরবরাহের সন্ধান করতে তার অগ্রাধিকার অর্জনে আগ্রহী। সম্প্রতি তুরস্ক কৃষ্ণ সাগরে শক্তির অন্বেষণ করে একটি বিশাল আবিষ্কার করেছে বলে দাবি করেছে, তবে ক্ষেত্রের আকারটি স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি এবং কিছু শক্তি বিশ্লেষক এরদোগানের এই দাবির সঠিকতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। কৃষ্ণ সাগরে গ্যাস প্রাপ্তি তুরস্কের জন্য “নতুন যুগের” অভ্যুদয় বলে ঘোষণা করে তুরস্ককে একটি শক্তি কেন্দ্র এবং গ্যাস রফতানিকারক দেশ হিসাবে পরিণত করবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন, এরদোগান। তারপরও তিনি,  ভূমধ্যসাগরের অধিকার নিয়ে আচ্ছন্ন।

গ্রীস তুরস্কের এই দ্বন্দ্বের মধ্যে নূতন মাত্রা দিয়েছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মেক্রন;  তিনি প্রত্যক্ষভাবে গ্রীসের পক্ষ অবলম্বন করে ইইউর অভ্যন্তরে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান সামরিক পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করেছেন এবং তুরস্ককে ভূমধ্যসাগরে অংশীদার হিসাবে দেখা যাবে না বলে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি গ্রীক প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকস মিতসোটাকিসকে ১৮ টি রাফায়েলে জেটের বিক্রয় সহ ফরাসী সামরিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন।

এদিকে বৃহস্পতিবার কর্সিকার দ্বীপপুঞ্জে দক্ষিণ ভূমধ্যসাগরীয় মেড ৭ গ্রুপের নেতাদের বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আবার ই ইউ কাউন্সিলের বৈঠকে তুরস্কের ব্যাংকিং খাতকে নিয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে আলোচনা হবে।তুরস্ক ও গ্রীসের অভ্যন্তরে মধ্যস্থতাকারী জার্মানি তুরস্ক এবং ইইউর মধ্যে এই বিরোধকে শান্ত করার জন্য একটি বর্ধিত শুল্ক ইউনিয়নের সম্ভাবনা অন্বেষণ করছে।

গত বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে হাইড্রোকার্বন সংরক্ষণ এবং নৌ প্রভাবকে কেন্দ্র করে তুরস্ক ও গ্রীসের মধ্যে উত্তেজনার বিষয়ে আংকারার তীব্র নিন্দা  করে বলেন, “টার্কিশ জনগণ কিংবা জাতির সাথে নয় বরং প্রেসিডেন্ট এরদোগান সরকারের অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপের ব্যাপারে ইউরোপকে পরিষ্কার এবং দৃঢ় ভূমিকা নিতে হবে।”
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ১৯৮০ সালের সামরিক অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে এক টেলিভিশন বক্তৃতায় গতকাল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মেক্রোনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তুর্কি জনগণের সাথে গণ্ডগোল করবেন না। তুরস্কের সাথে ঝামেলা করবেন না, ”। এরদোগান আরও বলেন, “মেক্রোন আপনি আমার সাথে আরও সমস্যা করতে চলেছেন”; তিনি তার ঐত্রিহাসিক জ্ঞানের অভাব বলেও মন্তব্য করেন।

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দুটি দেশের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব এবং তার সাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যাওয়া মোটেও সুখকর বিষয় নয়। অনেকেই আশা করেছিলেন ন্যাটোভুক্ত দুটি দেশের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিরসনে ন্যাটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ঘটেনি, ফ্রান্স প্রত্যক্ষ বাকযুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। এরদোগান এই সমরে একা সেটা নিশ্চয়ই তিনি অনুধাবন করেন। 

SHARE THIS ARTICLE