তোমার বিশ্বাসে বিষ ছিল, আমার নিঃশ্বাসে প্রেম (১ম পর্ব)

লেখক-রহমান ফাহমিদাঃ ১ম পর্ব-   ফেসবুক,ফেসবুক,ফেসবুক!কি করিস সারাদিন এই ফেসবুকে বসে থেকে?মা’র চিৎকারে মায়াবী ঘুরে তাকাল।তাকিয়ে দেখে মা,কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে দুইহাত কোমরে দিয়ে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে।মায়াবী ওর হরিণ কালো চোখ দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল আর মা অনবরত বকেই যাচ্ছে।

কিরে’তোর কি আক্কেল হবেনা!কতবেলা হয়ে গেল,এখনো নাস্তা না করে বসে আছিস, এই ছাই-ভস্ম নিয়ে।সবাই নাস্তা করে যার যার কাজে চলে গেছে আর তিনি কিনা নবাবের বেটির মত ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন!বলি,বয়স কি বাড়ছে না কমছে!কিরে,কথার কোন উত্তর দিচ্ছিস না যে,আবার চোখও নামাচ্ছিস না!আমি কি ভুত?যে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছিস?

মায়াবী মুখ ফসকে বলে ফেল্ল-মা, তোমাকে কিন্তু এখন সেরকমই লাগছে।

ও যেভাবে মুখচোখ বেঁকিয়ে বলছে,তা দেখে মা’র রাগ পড়ে গেল!মা ওর কথাতে না হেসে পারলনা।তাই হেসে উঠে বল্ল,কি বললি?আমি ভুত!তাহলে তুই ভূতের বাচ্চা।তারপর দুজনেই জোরে জোরে হেসে উঠলো।  

মায়াবীর চোখদুটির মধ্যে এত মায়া যে কেউ ওর সাথে রাগ করে থাকতে পারবেনা।চোখের দিকে তাকালেই সব রাগ ধুলিৎসাত হয়ে যাবে।অপূর্ব সুন্দর টানাটানা হরিণ কালো চোখ দুটিই ওকে সবার কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।মায়াবীর দেহের গড়ন তেমন লম্বাটে নয়,মাঝারি আকারের।সম্ভবত পাঁচ ফুট দুই কি তিন হবে।গায়ের রঙটা শ্যামলা।মুখটি গোলাকার।চুল পিঠ পর্যন্ত।সবসময় হাসিখুশি থাকে এবং প্রচুর বই পড়ে।গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে ওর খুব ভালো লাগে,তাইতো সেই ক্লাস এইট থেকে সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা কাহিনী “ফেলুদা’র” সবকটি সিরিজ,কতবার যে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই!তাছাড়া সত্যজিৎ রায়ের মুভি“সোনার কেল্লা”এখনো সময় পেলে দেখে।সেই সাথে ফেলুদার যতগুলো মুভি নির্মাণ হয়েছে ও সবকয়টি দেখেছে।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা ওর খুব প্রিয়।সুনীলের “কেউ কথা রাখেনি” কবিতাটি মায়াবীর ঠোটোস্ত মুখস্থ সেই ছোটবেলা থেকেই।ইংরেজি রাইটারদের মধ্যে সিডনি স্যালডনের লেখা বইগুলো ওর অনেক প্রিয়।লেখাপড়ায় সে খুব ভাল।বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে শহরের একটি নামকরা কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ছে।সে খুবই শান্ত প্রকৃতির তবে বড্ড অভিমানী।বাবা মাকে কখনো কোনোকিছু নিয়ে বিরক্ত করে না।তাই তো বাবা মা এবং ওর ভাইয়া ওকে খুব ভালোবাসে।ওর যত কথা ওর মায়ের সাথে কারণ কলেজ শেষে মাকেই বেশি কাছে পায়।বাবা আর ভাইয়া তো তখন তাদের নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকেন।তবে ওদের বাসার একটি নিয়ম আছে যে যেখানেই থাকুক,রাতে একসাথে ডিনার করবে।কারণ বাবা মায়ের ধারণা সে সময়টিতে সবার সাথে সবার, নানান রকম কথাবার্তা শেয়ারের ফলে আত্মিক সম্পর্কটা পোক্ত হয়।সবাই সবার  সুখদুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে পারে।কেউ ফ্রাসট্রেশনে ভুগে না।মায়াবীর বাবা একজন ব্যবসায়ী।আর ভাইয়া ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।যদিও বাবার ইচ্ছে ছিল,ভাইয়া ডাক্তারি পড়বে কিন্তু ভাইয়ার কোন আগ্রহ ছিলনা।তবে মা খুব খুশী কারণ মা ডাক্তারি পছন্দ করেন না।তারপরেও বাবা হাল ছাড়েননি।বাবার ইচ্ছা,মায়াবীকে ডাক্তারি পড়াবেন।মায়াবী অবশ্য কোন কিছু চিন্তা করেনি,কেননা আজকাল বোর্ডের পরীক্ষাগুলোর যে অবস্থা!প্রশ্নপত্র ফাঁস,রেজাল্টে গড়বর।তাই মায়াবী ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছে সব।আগে এইচএসসি দিক,তারপর দেখা যাবে!

মা,আজকে যে ফেসবুক নিয়ে বকাবকি করছে!সেই ফেসবুকের প্রতি মায়াবীর কখনই কোন ইন্টারেস্ট ছিলনা।বান্ধবীদের চাপে এবং ফাহিমের জন্য এই ফেসবুক আইডি খুলতে হয়েছে। কারন ওর বান্ধবীরা গ্রুপিং করে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কথা বলে। ফলে ও যখন ওদের কাউকে কল করে তখন ওরা সবাই ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে ব্যস্ত থাকে।ওর সাথে একা একা কেউ কথা বলেনা।এখন অবশ্য মজা লাগে সবার সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করতে।এইতো গেল বান্ধবীদের কথা।আরেক জনের জন্য মায়াবী ফেসবুকের আইডি খুলেছে,যার নাম ফাহিম।ফাহিম হল,মিলা আপুর ভাই।আর মিলা আপু হল,মায়াবীর ভাইয়ার বান্ধবি।ফাহিম আবার মায়াবীর বাবার বন্ধুর ছেলেও।ভাইয়া ও মিলা আপু একসাথে বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ফোর্থ ইয়ারে পড়ছে।আর ফাহিম নটডেম কলেজে পড়ছে।

মিলা আপু যখন ভাইয়ার কাছ থেকে নোট নিতে আসে তখন ফাহিমও মিলা আপুর সাথে আসে।ফাহিম আর মায়াবী এক সাথে বসে গল্প করে।এভাবেই কখন যেন দুজনের দুজনকে ভালোবাসতে শুরু করেছে তা নিজেরাও জানেনা!তেমনি বাড়ির কেউও এখনো জানেনা বা বুঝতে পারেনি ওদের প্রেম কাহিনী শুরুর কথা।তবে ওরা যে ভাল বন্ধু তা জানে সবাই।ফাহিমের জন্য মায়াবী ফেসবুক আইডি খুললেও ওর সাথে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারের চেয়ে ভাইবারেই বসা হয় বেশি।ফাহিম ভাইবার ইউজ করে তাই মায়াবীরও ভাইবার ইন্সটল করতে হয়েছে।তাই ওখানেই ওদের কথা ও ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে দেখা হয় বেশী।ফাহিম মায়াবীর সাথে ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে কথা বলতে বেশি পছন্দ করে,ওর নাকি মায়াবীর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে।তাছাড়া ওর ধারণা অন্যের হাত থেকে বাঁচার বা ওদের প্রেমের খবর লুকানোর জন্য ভাইবার সবচেয়ে নিরাপদ।কারণ ভাইবারে সবকিছু ডিলিট করা যায়।    

ফাহিম দেখতে মোটামুটি সুন্দর।তবে ওর ব্যায়াম করা পিটানো শরীর দেখে সবাই প্রথমেই হা হয়ে যায়।মাথাভর্তি চুলগুলো কোঁকড়ানো।হাসিখুশি চঞ্চল একটি ছেলে।টিশার্ট আর জিন্স ওর পছন্দের পোশাক তবে পাঞ্জাবীতে ওকে দারুন লাগে!ফাহিম  এমন একটি ছেলে যে,কখন যে কি ভাবে!হয়তো নিজেও জানেনা।কথা বলে অনবরত।যখন হাসে প্রাণ খুলে হাসে।মিলা আপুর খুব প্রিয় ভাই আর বাবা মায়ের আদরের সন্তান।তাই যখন যা চায় তাইই পায়,সেইকারণে ওর ধারণা যে,ও যখন যা চাইবে তাইই পাবে!ওর এই অহমিকা মায়াবীর ভালো লাগেনা।মায়াবী মনে করে ওর ধারণা ভুল!কেননা সৃষ্টিকর্তা বলে সবার ওপরে একজন আছেন।ফাহিম,আগে মিলা আপুর সাথে সবসময় আসতো কিন্তু এখন মায়াবী কলেজে উঠার পর ফাহিম একা একাই ওদের বাসায় আসে।কেউ কিছু মনে করেনা কারণ সবাই জানে, মায়াবী কোন পড়া বা অংক না বুঝলে ফাহিম ওকে সাহায্য করে।যেহেতু দুজনে একই ক্লাসে পড়ে এবং ছোটবেলা থেকে মানে স্কুল থেকেই দুজনে নিজেদের পড়া শেয়ার করে পড়ছে।এমনকি ফাহিম আর মায়াবী একই কোচিং-এ একই সাথে পড়ালেখা করছে।তাই অন্যকিছু ভাবার অবকাশ নেই!যদিও এরই মাঝে বয়সের সাথে সাথে দুজনের মন দেয়ানেয়ার পালা শেষ!যা কিনা এখনো দুই বাড়ির কেউই টের পায়নি।মায়াবীর চেয়ে ফাহিম এই ব্যাপারে বেশী সচেতন।তাই সবসময় মায়াবীকে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলে।মায়াবীও ফাহিমের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছে।

(চলবে—)

SHARE THIS ARTICLE