শহীদুল ইসলামঃ
নফল ইবাদত বলতে বুঝানো হয় আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য যে ইবাদত করা হয়, কিন্তু তা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদা বা গায়রে মুয়াক্কাদা কোনো কিছু নয়।
কখনো কখনো নফল দ্বারা ফরজ, ওয়াজিব ছাড়া বাকি সব ইবাদতকে বুঝানো হয়। তবে প্রথম ব্যবহারটি ব্যাপক প্রচলিত।
নফল ইবাদতের উদ্দেশ্য:
নফল নামাজের দ্বারা মূলত আল্লাহর প্রতি বান্দার মহব্বতের পরিমাপ করা হয়। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহকে ভালোবাসার বিষয়টি যাচাই হয়। বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে এভাবে বুঝানো যায় যে, মালিকের পক্ষ থেকে কর্মচারিদেরকে দৈনিক কাজের রুটিন ঠিক করে দেয়া হয়। যা তাকে অবশ্যই করতে হবে।
সব কর্মচারি রুটিন অনুযায়ী কাজ করে নিজের গন্তব্যে চলে যায়। কিন্তু একজন কর্মচারি এমন যে, নিজের দায়িত্ব পালনের পর মালিকের ব্যস্ততা দেখে বাড়িতে যায় না। বরং মালিকের সাহায্যে লেগে যায়। মালিকের প্রতি বাড়তি মহব্বত ছাড়া কারো পক্ষে এমন করা সম্ভব নয়।
যদিও আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে সহযোগিতার উদাহরণ ঠিক নয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন করার পর, অতিরিক্ত নফল ইবাদতে লিপ্ত থাকা মূলত তার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
সে, ওই কর্মচারির ন্যায় সবাই যখন দায়িত্ব পালন করে বাসায় চলে যাচ্ছে, মালিকের প্রতি মহব্বতের কারণে সে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। মোটকথা নফল ইবাদতের মাধ্যমে মূলত আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পরিমাপ করা উদ্দেশ্য।
বান্দার পক্ষে কখনো সম্ভব নয় যথাযথভাবে আল্লাহর ফরজ ও ওয়াজিব বিধি-বিধানগুলো পালন করা। বরং ওগুলো পালন করতে গিয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি হওয়াই স্বাভাবিক। নফল বিধান রাখার উদ্দেশ্য হলো, এর দ্বারা ফরজ ও ওয়াজিব বিধি-বিধান পালনের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো পূরণ করা।
এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেন, নিশ্চয় কেয়ামতের দিন বান্দার আমলেন মধ্য থেকে যে বিষয়ের হিসাব নেয়া হবে তা হচ্ছে নামাজ। আমাদের রব, ফেরেশতাদেরকে বলবেন, (যদিও তিনি নিজ থেকে সবকিছু জানেন) তোমরা আমার বান্দার নামাজের দিকে তাকাও, তারা কি নামাজ যথাযথভাবে আদায় করেছে নাকি কোনো ত্রুটি করেছে? যারা যথাযথভাবে আদায় করেছে তাদের ক্ষেত্রে তা লিখে দেয়া হবে।
আর যদি ফরজ নামাজে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তাহলে আল্লাহ তায়ালা বলবেন, দেখো, আমার বান্দার কোনো নফল ইবাদত আছে কিনা? নফল ইবাদত থাকলে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দেবেন, তোমরা ফরজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো নফল দ্বারা পূর্ণ করে দাও। তারপর আল্লাহ তায়ালা পূর্ণ অবস্থায় বান্দার আমলকে গ্রহণ করবেন’। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ৮৬৪)
আবু দাউদের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘তারপর জাকাতের বিষয় ওঠানো হবে। এবং নফল দান-সদকা দ্বারা ফরজ জাকাতের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো পূরণ করা হবে। এরকমভাবে চলতে থাকবে’। (সুনানে আবু দাউদ-৮৬৬)
আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, সব নফল ইবাদতের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ওই ধরনের ফরজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো পূরণ করা।
বর্তমানে ইবাদতে ইখলাস ও একাগ্রতার ঘাটতি প্রকট। ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুলের শর্তগুলো অনুপস্থিত। তাই ইবাদতের সুফল ভোগ করা যাচ্ছে না। অতএব, সবার কর্তব্য হলো, ফরজ আমলের ত্রুটিগুলো পূরর্ণের জন্য আল্লাহ তায়ালা যে ব্যবস্থা রেখেছেন তা অবলম্বন করে চলা।
নফল ইবাদতের ফায়দাসমূহ-
এক. আল্লাহ তায়ালার মহব্বত অর্জন : হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে দুশমনি করবে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো। বান্দা যেসব আমলের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমার ফরজ বিধি-বিধান।
বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। যখন তার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে। হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে। পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। (মুজামুল কাবির লিততবরানি, হাদিস নম্বর: ৭৮৩৩)
উক্ত হাদিস থেকে নফল ইবাদত দ্বারা আল্লাহর মহব্বত লাভ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ হয়। কোনো ব্যক্তির জন্য আল্লাহর মহব্বত হাসিল হলে সারা দুনিয়া তার হয়ে যায়। এজন্য প্রবাদে আছে, যার জন্য মাওলা (আল্লাহ) হয়ে যায় তার জন্য সারা দুনিয়া হয়ে যায়। রাসূল (সা.) উক্ত হাদিসে আল্লাহর অলিদের সঙ্গে দুশমনি রাখতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। যে ব্যক্তি দুশমনি রাখবে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন।
তাছাড়া নফল ইবাদতের দ্বারা আল্লাহর মহব্বত হাসিল হওয়া যৌক্তিক দাবিও বটে। কারণ, কর্মচারি নিজের দায়িত্ব পালন করার পর, অতিরিক্ত কাজ হিসেবে মালিককে সহযোগিতা করলে সে মালিকের কাছে অবশ্যই প্রিয়পাত্র হবে। তদ্রুপ যে বান্দা মালিকের পক্ষ থেকে দেয়া ফরজ বিধানগুলো আদায়ের পর, মালিকের খুশির জন্য অতিরিক্ত আমলে ব্যস্ত থাকে সেও আল্লাহর প্রিয় বান্দা হবে।
দুই. মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং গুনাহ মাফ হয় : নফল ইবাদতের দ্বিতীয় উপকার হলো, এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা দরবারে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি হয়। যেমন: নবী করিম (সা.) এক হাদিসে বলেন, তোমার দায়িত্ব হলো আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি সেজদা করা। কারণ, সেজদার পরিমাণ যত বাড়তে থাকে সে অনুযায়ী আল্লাহর দরবারে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এবং গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ৪৮৮)
গুনাহ মাফের প্রসঙ্গ আল কোরআনেও এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি নামাজ আদায় করো দিনের দুই প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে। নিশ্চয় সৎ কাজ গুনাহকে ধ্বংস করে দেয়’। (সূরা : হুদ, আয়াত : ১১৪)
নফল ইবাদতের দ্বারা অবশ্য সগিরা গুনাহ মাফ হয়। কবিরা গুনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না।
তিন. রাসূল (সা.) এর সঙ্গে জান্নাতে স্থান হয় : নফল ইবাদতের আরেকটি উপকার হচ্ছে, বেশি বেশি নফল ইবাদতের দ্বারা রাসূল (সা.) সঙ্গে জান্নাতে স্থান হবে। রাবিয়া ইবনে কাব আসলামি (রা.) বলেন, আমি একদিন রাসূল (সা.) এর সঙ্গে রাত্রি যাপন করি। রাতে আমি রাসূল (সা.) এর জন্য ওজুর পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তু এনে রাখি।
তখন রাসূল (সা.) আমাকে বলেন, তুমি কিছু চাও। তখন আমি রাসূল (সা.) এর কাছে জান্নাতে একসঙ্গে থাকার আবেদন করি। রাসূল (সা.) বলেন, অন্য আরো কিছু? আমি বলি অন্যটাও তাই। তখন রাসূল (সা.) বলেন, তুমি আমাকে বেশি বেশি নফল ইবাদতের মাধ্যমে সহযোগিতা করো’। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ৪৮৯)
চার. গুনাহ থেকে হেফাজতে থাকা যায় : মানুষ নফল ইবাদতে ব্যস্ত থাকলে গুনাহ থেকে হেফাজতে থাকতে পারে। ইবাদতে মশগুল থাকার কারণে শয়তানের তরফ থেকে প্ররোচনা কম থাকে। অন্তর থেকে অন্ধকার দূর হয়। বিশেষভাবে জিকিরের দ্বারা অন্তর পরিস্কার হয়।
আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে বলেন, ‘আপনি তেলাওয়াত করুন যা আপনার কাছে ওহি করা হয়েছে কিতাব থেকে। এবং নামাজ কায়েম করুন। নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও গুনাহের কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে। আল্লাহর জিকির সবচেয়ে উঁচু। আল্লাহ তায়ালা জানেন তারা যা করে’। (সূরা : আনকাবূত, আয়াত নম্বর : ৪৫)
ইমাম ইবনুল কায়্যিম আল জাওজি উক্ত আয়াত দিয়ে প্রমাণ পেশ করেন যে, সর্বোত্তম জিকির হলো আল্লাহর নামের জিকির।
পাঁচ. রাসূল (সা.) এর অনুকরণ : বেশি বেশি নফল ইবাদত করা রাসূল (সা.) এর অভ্যাস ছিলো। তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার জিকির করতেন। বেশি বেশি ইবাদত করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতেন। তিনি এত বেশি তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন যে, পা ফুলে যেতো।
হজরত আয়শা (রা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ তায়ালা আপনার পেছনের, সামনের সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তারপরও আপনি কেন এত বেশি ইবাদত করেন? রাসূল (সা.) তখন বলেন, ‘আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না’? (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নম্বর : ১৮১৫৯)
অর্থাৎ রাসূল (সা.) এর ইবাদত ছিলো আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য। আল কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী রাসূল (সা.) অর্ধেক রাত পর্যন্ত নফল নামাজে মশগুল থাকতেন। অতএব, যে ব্যক্তি নফল নামাজ, দান-সদকা, রোজা, হজ-উমরা ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য চায়, সে মূলত রাসূল (সা.) এর অনুকরণ করে।
আর এভাবে সে আল্লাহর মহব্বত, রহমত ও গুনাহ মাফের হকদার হয়। এ বিষয়ের পুরস্কার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তাহলে আমার অনুসরণ করো তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন। তিনি তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়ালু’। (সূরা আলো ইমরান, আয়াত নম্বর : ৩১)
নফল ইবাদত সম্পর্কে ভুল ধারণা :
নফল ইবাদতের ব্যাপারে আমাদের কয়েকটি ভুল ধারণা রয়েছে। যে কারণে আমরা আল্লাহর ভালোবাসা থেকে বিরত হচ্ছি। প্রথমত, অনেকে মনে করেন নফল মানে অতিরিক্ত ইবাদত। তা না করলেও সমস্যা নেই। কিন্তু নফল নামাজের লক্ষ্যের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তা অতিরিক্ত কোন বিষয় নয়। বরং ফরজ ইবাদত পালনের ঘাটতি পূরণ করা হয় নফল দিয়ে।
তাছাড়া নফল ইবাদতকে নামাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু নামাজ ছাড়া অন্যান্য বিধি-বিধানের ক্ষেত্রেও নফল আদায়ের সুযোগ রয়েছে।