নববর্ষ ২০২৩ঃ শুভেচ্ছা-প্রার্থনা এবং প্রত্যাশা

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদার ঃ আস সালামু আলাইকুম, সকলের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আনন্দ আর সুখ আমাদের জীবনকে আরও আলোকোজ্জ্বল করে তুলুক, নতুন বছর ২০২৩ এর শুরুতে স্বদেশে এবং প্রবাসে বসবাসরত সকল বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য প্রাণঢালা ফুলেল শুভেচ্ছা আর রাশি রাশি আনন্দ আর সুখের প্রত্যাশা। সকলের সুস্থতা প্রার্থনা।

২০২১ সালে শুভেচ্ছা-প্রার্থনায় আমি লিখেছিলাম,

“আনিলাম,
পরিবর্তীত শুভেচ্ছা-প্রার্থনা ধরনীতে,

নব-বরষে আমি তুলিলাম দুটো হাত,
স্রষ্টা সমীপে,
দুটো হাত একে একে রূপান্তরিত হলো লক্ষ কোটি হাতে,
জানেন অন্তর্য্যামী,
কি কামনা শুভেচ্ছা-প্রার্থনায় আমার!

বিধাতার কাছে, এ নূতন বছরে কামী,
কোভিডের ধ্বংস দানি,
শুভেচ্ছা-প্রার্থনাকে স্বীকার করো হে স্রষ্টা নিরাকার।”

২০২৩ সালে,
আসুন, আমাদের শুভ ইচ্ছাকে ধারণ করি,
লালন করি, উজ্জীবিত করি, স্থাপন করি,
তেইশ সালে মহামারীকে করি পরাজিত,
যুদ্ধ-বিগ্রহকে করি নমিত,
জিঘাংসা-বিদ্বেষ করি অবদমিত;
মূল্যস্ফীতিকে করি পরাভূত,
দুর্নিতিকে করি পর্য্যুদস্ত,
অবক্ষয়কে করি ক্ষয়িত,
হিংসা-বিদ্বেষকে করি পরাভূত,
ঐক্যের মশালকে করি উজ্জীবিত;
হে, অন্তর্য্যামি, 
আমাদের প্রত্যাশাকে করো প্রতিষ্ঠিত।। 


কোভিড মহামারী কি মৃত?

২০২২ সাল বিদায় নিয়েছে, ২০২৩ সালের আগমনী বার্তা আমাদের কানে বাজছে। ২০২০ এবং ২০২১ সাল এই দুটি বছর ব্যাপী যে বৈশ্বিক দুর্যোগ মহামারী চলছিলো ২০২২ সালে এসে মহামারীর প্রকোপ শেষ না হলেও কোভিড ভাইরাস হারিয়েছে তার মারাত্নক সংক্রমণের ক্ষমতা। ইতিমধ্যে কোভিডের কারণে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা ৬৬ লক্ষ ৯৬ হাজার ৭৪৬ অতিক্রম করেছে। এই পরিসংখ্যান যে সর্বাত্নক সঠিক নয় তা হলপ করে বলা যায়, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মৃত্যুর পরিসংখ্যান আরও অনেক বেশীই হবে। ইতিমধ্যে আবিষ্কার হয়েছে কোভিডের টিকা, দেশে দেশে অনেকেই ইতিমধ্যে এই টিকার চতুর্থ ডোজ গ্রহণ করেছেন। যদিও বিশ্বের অনেক মানুষ এখনো টিকার আওতায় আসেনি। কোভিডের সংক্রমণের হার কমেছে একই সাথে কমেছে তার দুরন্তপনা, কমে এসেছে কোভিডের কারণে মৃত্যুর হার। যদিও কোভিড এখনো বিশ্ব থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি কিন্তু অতিমারি কি শেষ হয়েছে? না অতিমারির আনুষ্ঠানিক মৃত্যু এখনো হয়নি এবং কবে হবে তা বলা দুঃসাধ্য। হতে পারে এই কোভিড ভাইরাস দীর্ঘদিন আমাদের মাঝে থেকেই যাবে।

মূল্যস্ফীতি:




২০২২ সালে কোভিড সংক্রমণ কমের দিকে আসতে থাকলে মানুষের মনে কিছুটা স্বস্তি দেখা দিলে নতুন বিপর্য্যয় আমাদের গ্রাস করে। সারা বিশ্বে নেমে আসে গভীর মূল্যস্ফীতি। এ যেন আরেক মহামারী, সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশ এই মূল্যস্ফীতির জালে আটকে গেছে। বছরের শেষে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির এই হার প্রায় ৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।

সর্বত্র মুদ্রাস্ফীতির এই  প্রবলতার সাধারণ কারণগুলি ছিল জ্বালানি এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি। সরবরাহ ধারায় কোভিড-১৯ এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব, ব্রেক্সিট এবং সর্বশেষ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারীতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এই ধারাকে বিনষ্ট করে দিয়ে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো, প্রধান অপরিশোধিত তেল উৎপাদক রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় তেলের দাম এক তৃতীয়াংশ বেড়েছে। খাদ্যের দামও বেড়েছে, সার এবং পরিবহন খরচের পাশাপাশি প্রধান গম উৎপাদনকারী ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার শস্য রপ্তানির অবরোধের কারণে। মূল পণ্যের দামের আকস্মিক বৃদ্ধি বিশ্বের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে দ্রুত ক্ষত সৃষ্টি করেছে। রাশিয়ান গ্যাসের উপর ইউরোপের দীর্ঘ নির্ভরশীলতার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই শীতে নিজেদের উষ্ণ রাখার সংগ্রামে ব্যাপৃত থাকবে।

আয়ারল্যান্ডেও এই মূল্যস্ফীতি ৮.৯ শতাংশের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে জালানি তেলের মূল্য লিটার প্রতি ২ ইউরোর বেশী হয়ে গিয়েছিল, যদিও এই মুহূর্তে এই মূল্য কমে এসে ১.৫০ ইউরোর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। আশা করা যাচ্ছে তেলের মূল্য কমে আসার সাথে সাথে অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য কমে আসবে এবং কিছুটা হলেও আনুপাতিক স্বস্তির আলো দেশের মানুষ দেখতে পাবে।

বাংলাদেশেও ২০২২ সাল ছিল লাগামহীন দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির বছর। বৈশ্বিক কারণগুলোর সাথে স্বদেশে দূর্নীতি এবং ব্যাংক থেকে অর্থ লুটতরাজ এবং বিদেশে পাচার অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করেছে। ভোজ্যতেল ও চালের মূল্য রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। টিসিবির লাইনে অপেক্ষমাণ মানুষের দীর্ঘ লাইন ছিল দৃষ্টিকটু। এসব লাইনে নিম্নবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আমাদের আশাহত করেছে। ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, বেসরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি আরও অনেক বেশি। এ বছর জ্বালানি তেলের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। জনজীবনে নাভিশ্বাস এসেছে, শিল্পকারখানায় কর্মী ছাঁটাই বেড়েছে। ২০২২ ছিল বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকট, ক্ষুধা ও বেকারত্বের বছর, নিম্ন ও মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনের বছর।

 

করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধকেন্দ্রিক বৈশ্বিক সমস্যার সঙ্গে, ব্যাপক আমদানি বৃদ্ধি, অকার্যকর মুদ্রানীতি ও রিজার্ভ ঋণ ফেরত না আসা, ব্যাংকিং অপব্যবস্থাপনা, ঋণখেলাপি, পাচার—সব মিলে দেশের ডলার রিজার্ভের পতন হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি হয় প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ৮৩ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড আমদানি বাড়ায়, ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানিও অর্থনীতিকে স্বস্তি দেয়নি। বরং ডলার বাঁচাতে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করলে তেল-গ্যাসের অভাবে কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে রাখা হয়। শিল্পের কাঁচামাল, ট্রেডিং পণ্যসহ যাবতীয় আমদানির ঋণপত্র বা এলসি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতেও ডলার রিজার্ভের পতন ঠেকানো যায়নি, সরকারকে নিজস্ব আমদানি এবং বেসরকারি চাহিদায় ক্রমাগতভাবে খোলাবাজারে ডলার ছাড়তে হয়েছে। এক পঞ্জিকাবর্ষে ডলারের বিপরীতে টাকার ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরপতন ঘটেছে। এক বছরে সরকারি হিসাবেই ডলার রিজার্ভের ক্ষয় হয়েছে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। ডলারের রেট ৮৬ টাকা থেকে বেড়েছে ১০৬ টাকা।

ডলার সংকটে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বছরের আলোচিত ঘটনা ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে তিন বছরে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য সরকারের আবেদন এবং ঋণের শর্ত নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা। অভিযোগ উঠেছে, সরকার আইএমএফের শর্ত মানার ইঙ্গিত দিতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে, ব্যাংক ঋণের খেলাপি পরিমাণ কমাতে, ৬-৯ শতাংশের সুদের হার তুলে দিতে, রিজার্ভের হিসাবপদ্ধতি সংশোধন করতে সম্মত হয়েছে। দেশের পরিসংখ্যান মান, আর্থিক খাতের তথ্য স্বচ্ছতা নিয়ে আইএমএফ যৌক্তিক প্রশ্ন তুলে সরকারকে বিব্রত করেছে।

২০২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনার দিকে তাকানোর একটি উপায় হল সরবরাহ ব্যাবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসা এবং কমে যাওয়া চাহিদা আশাব্যঞ্জকভাবে, ২০২২ সালের শুরুর দিকে মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করে এমন কিছু কারণ স্থবির হতে শুরু করেছে। সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসায় ভোগ্যপণ্যের দাম কমেছে। তেলের দাম এক বছর আগের স্তরে ফিরে এসেছে, আংশিকভাবে উৎপাদন পুনরুদ্ধারের কারণে। কঠোর মুদ্রানীতি চাহিদা কমিয়ে দেয়াও অর্থনীতিতে কাজ করতে শুরু করেছে। সর্বাধিক সংবেদনশীল খাতগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে: একসময়ের জমজমাট সম্পত্তির বাজারে হঠাৎ ঠাণ্ডা স্থির হয়েছে, লেনদেন শুকিয়ে গেছে। যদি সরবরাহ ব্যাবস্থায় শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং ইচ্ছুক প্রার্থীদের চাকুরীর সংস্থান করা না যায় তাহলে বৈশ্বিক মন্দা এসে সারা বিশ্বকে গ্রাস করতে পারে বলে অনেক অর্থনীতিবিদরা সংকেত দিয়েছেন। তাই দেশে দেশে সরকাররা আগেভাগেই পদক্ষেপ নিচ্ছেন।


দি ইকোনোমিস্ট পত্রিকার সাম্প্রতিক মন্তব্যে বলা হয়েছে যে, “২০২৩ সাল একটি ভয়াবহ এবং সম্ভাব্য বিপজ্জনক বছর হওয়ার প্রচুর কারণ রয়েছে, কিন্তু যেহেতু প্রতিটি সংকট নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেয়, তাই বর্তমান অস্থিতিশীলতার মধ্যে কিছু ভালো খবর আছে। কিছু দেশ অন্ধকারের মধ্যে সমৃদ্ধ হবে। উপসাগরীয় অর্থনীতিগুলি উজ্জীবিত হচ্ছে, উচ্চ জালানি মূল্য থেকে নয় বরং আর্থিক উদ্যোক্তা হিসাবে তাদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা গুরুত্ব বহন করছে। ২০২৩ সালে চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে পরিণত হবে ভারত, ছাড় দেওয়া রাশিয়ান তেল, ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ এবং চীন থেকে দূরে সরে গিয়ে বিদেশীদের সাথে ব্যাবসায়ে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ তাদের অর্থনীতিকে উজ্জ্বলতর করবে। সাধারণভাবে বলা যায়, ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং বৈশ্বিক মন্দার আগের সময়ের তুলনায় উদীয়মান অর্থনীতিগুলি তুলনামূলকভাবে ভাল করবে।”


বিশ্ব রাজনীতি:

অদ্বিতীয় ভারতীয় পণ্ডিত চাণক্যের ভাষায় “প্রতিটি বন্ধুত্বের পিছনে কিছু স্বার্থ থাকে। স্বার্থ ছাড়া বন্ধুত্ব হয় না। এটা একটা তিক্ত সত্য।” চাণক্যের এই কথাগুলি রাজনীতিতে বিদায়ী বছরটিকে ভালভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। পিছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ২০২২ সাল বিশ্ব রাজনীতিতে একটি ইতিবাচকতার সন্ধিক্ষণ হতে পারত, যখন মহামারী স্তিমিত হয়ে আসছিলো আর বিশ্ব ব্যবস্থা পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছিল, ঠিক সেই সময়ে শক্তির চাকা দুলে উঠলো আর শক্তিশালী দেশের নির্মম স্বার্থের নিকট বলী হয়ে গেলো বিশ্ব। এই অবস্থায় বৈশ্বিক শক্তির বলয়ের পরিবর্তনে ভারত, তুরস্ক, সৌদি আরব এবং ব্রাজিলের মতো উপ-পরাশক্তিগুলি তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা, প্রভাব বিস্তার এবং সুবিধা লাভের জন্য জোর ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে।

এই শক্তির বলয়ে ভণ্ডামি আর দুর্বলতার সুযোগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব ব্যাবস্থাকে আবারো অস্থিতিশীল করে তুললো। আফগানিস্তানে তালেবানদের নিকট আমেরিকার লজ্জাজনক পরাজয় আর পলায়নের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি পঙ্গু যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ন্যাটো ভ্লাদিমির জেলেনস্কিকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে আর তাদেরকে মানসিক সহায়তা প্রদান করছে কিন্তু তারা রাশিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা বিশ্ব এই যুদ্ধে না জড়ানোর ইংগিত পাওয়ার পরই রাশিয়া এই আগ্রাসনের মানসিক শক্তি পেয়েছে। এভাবেই পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব অস্ত্র ব্যাবসাকে তুঙ্গে পৌঁছে দিয়েছে।

২০২২ সালে এই যুদ্ধের সময়ে জার্মানী এবং ফ্রান্স রাশিয়া থেকে তেল, গ্যাস, সার এবং আরও কিছু সামগ্রী আমদানি অব্যাহত রেখেছে। যার কারণে রাশিয়ার পণ্য বয়কটের সিদ্ধান্তের পরও রাশিয়ার অর্থনীতি বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়েনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাশিয়া থেকে আমদানি বেড়েছে প্রভূত মাত্রায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্টোবরের মধ্যে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি এক বিলিয়ন ডলার থেকে শূন্যে নামিয়ে আনলেও, এটি রাশিয়া থেকে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের কাঠ, ধাতু, রাবার এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি অব্যাহত রেখেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফর সত্ত্বেও সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রকে তেমন গুরুত্ত্ব না দিয়ে ১৩ জাতি ওপেকের নেতৃত্বে থাকা  মোহাম্মদ বিন সালমান তেলের দামের জোয়ার বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নভেম্বর থেকে প্রতিদিন দুই মিলিয়ন ব্যারেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে হোয়াইট হাউসকে ক্ষুব্ধ করেছেন। এমনকি ইসরায়েলও জেলেনস্কির কান্নাকাটি তোয়াক্কা করেনি এবং রাশিয়ার সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও লিকুদ পার্টির  বেনজামিন নেতানিয়াহু আবার ফিরে এসেছেন ক্ষমতায়, তবুও আন্তর্জাতিক নীতিতে এই পরিবর্তন তেমন কোন প্রভাব রাখবে বলে মনে হচ্ছেনা।



এদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শী জিনপিং তৃতীয়বারের মত কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নির্বাচিত হওয়ায় তার ক্ষমতার বলয় আরও শক্তিশালী হয়েছে, তাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। শুধুমাত্র কোভিড মহামারীতে তাদের জিরো টলারেন্স নীতি ব্যার্থ হওয়ায় এই নীতি বিসর্জন দিয়ে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ খুলে দেয়ার নতুন নীতি গৃহীত হয়েছে। এদিকে যুক্তরাজ্য পড়েছে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কবলে। লিজ ট্রাসের স্বল্পদিনের ক্ষমতায় আরোহণ যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিকে পর্য্যুদস্ত করে দিয়েছে। ইতিহাস সৃষ্টি করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত রিসি সুনাক নূতন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবার পর অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও অদূর ভবিষ্যতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির করাল গ্রাস থেকে উঠে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।


২০২২ সালে ভারত স্বকীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাশিয়ার সাথে সু-সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। এখন ভারত জি-২০ দেশগুলোর প্রধানের দায়িত্বে থাকায় গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কংগ্রেস আরও দুর্বল অবস্থানে গিয়েছে আর বি জে পি গুজরাটে বিজয়ের রেকর্ড করে নিজেদের উত্তরোত্তর শক্তিশালী করে তুলেছে।

পাকিস্তানে ইমরান খান ক্ষমতা হারিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন আর পাকিস্তান মুসলিম লীগের শাহবাজ শরিফের প্রধানমন্ত্রীত্বের বয়স ৮ মাস অতিক্রম করে ৯ মাস হতে চলেছে।

বাংলাদেশ সম্প্রতি মেট্রোরেল জগতে প্রবেশ করে যোগাযোগ ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। পদ্মাসেতুও যোগাযোগ ব্যাবস্থায় গুরুত্ত্বপূর্ন পরিবর্তন এনেছে। আগামী বছরের প্রতীক্ষিত নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতি কিছুটা আন্দোলিত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা জনমনে উষ্মার জন্ম দিয়েছে। কূটনীতিবিদদের বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ কোনভাবেই কাম্য না হলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দুর্বলতা তাদের সুযোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা অব্যাহত আছে এবং সেটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জনমনে সংশয় থাকায় আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকেই যাচ্ছে। শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রান্তিক মেরুকরণ করে দিয়েছে, যার কারণে স্থিতিহীনতার ঝুঁকিতে থাকছে বাংলাদেশ। সচেতন জনগণ প্রবহমান স্থিতিশীল একটি গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থা প্রত্যাশা করে। ২০২৩ সালে সে রকম ইতিবাচক উত্তরণের কোন ইংগিত এখনো পরিলক্ষিত হয়ে উঠেনি।

 
বিশ্ব ক্ষমতার বলয়ে বিবর্তন অব্যাহত আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আগামী বছর বিশ্ব ভাগ্য নির্ধারনে গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে। যদিও এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে এবং আরও কতদিন এই যুদ্ধ চলবে সেটা নির্ধারিত হবে পশ্চিমা বিশ্ব এবং রাশিয়ার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। মনে করা হচ্ছ্বে পুটিনের ক্ষমতার বলয় অত্যন্ত শক্তিশালী। এই শক্তির সাথে যুক্ত হয়েছে চীন, উত্তর কোরিয়া ও ভারতের সমর্থন। পশ্চিমা বিশ্ব এই যুদ্ধ কতটুকু বহন করতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

প্রবাসে বাংলাদেশঃ

MIGRANTS FROM BANGLADESH IN THE WORLD | 1990-2022 - YouTube

বিগত কয়েক যুগে মূলতঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশীরা মাতৃভূমি ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি দিয়েছেন। ধীরে ধীরে এই অভিপ্রয়ান সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই বাংলা ভাষাভাষীদের নিয়ে গিয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশী অভিবাসীদের প্রকৃত পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারনা করা হয়, এই সংখ্যা ১ কোটী ২০ লক্ষ থেকে ১ কোটী ৫০ লক্ষ হতে পারে। ১৯২০ সাল থেকেই যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমাতে থাকেন বাংলাদেশীরা, ৭০ এর দশকে এই অভিবাসনের মাত্রা বৃদ্ধি হয়। আজ শুধু যুক্তরাজ্যেই ১০ থেকে ১৫ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশীর বসবাস বলে মনে করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে অভিবাসন যার ফলে অভিবাসীর সংখ্যা ৪-৫ লক্ষের কাছাকাছি হয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ডে প্রকৃত পরিসংখ্যান না থাকলেও ১০-১৫০০০ বাংলাদেশী বসবাস করছেন বলে মনে করা হয়।  

প্রবাসে সর্বত্রই বাংলাদেশীরা ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করে তুলছেন। সফলতাও এসেছে সর্বত্র। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিলে মিশে থেকেও তাড়া তাদের দেশকে ভুলে যান নি, তাদের ভাষাকে সংরক্ষিত রাখছেন, সংস্কৃতিকে ধারণ করছেন, লালন করছেন ধর্মকেও। যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে ইতিমধ্যে অনেক বাংলাদেশী অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, কাউন্সিলার হয়েছেন আর মেয়র হয়েছেন। বর্তমানে ৩ জন বাংলাদেশী এম পি যুক্তরাজ্যের সংসদে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। সংগঠনপ্রিয় বাংলাদেশীরা দেশে বিদেশে গড়ে তুলেছেন হাজারো সংগঠন। এর মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সংগঠন উল্লেখযোগ্য।

আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশীরা পিছিয়ে নেই। ইতিমধ্যে দুজন বাংলাদেশী স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছেন। একজন কাজী মোশতাক আহমেদ ইমন, ডাবলিন ডানলোরী কাউন্টী কাউন্সিল থেকে আর অপরজন আবুল কালাম আজাদ, লিমেরিক কাউন্টী কাউন্সিল থেকে নির্বাচিত হয়ে স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।

আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশীদের প্রধান সামাজিক সংগঠন অল বাংলাদেশী এসোসিয়েশন অব আয়ারল্যান্ড (আবাই) ২০১১ সাল থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে কার্য্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ২০২২ সালে এই সংগঠনের দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নূতন করে এই সংগঠন কার্য্যকর হয়েছে।

আশা করা যায় ২০২৩ সালে আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশীদের অবস্থান আরও দৃঢ় হবে। সাংগঠনিক কার্য্যক্রম দাঁড়িয়ে যাবে শক্তিশালী ভিত্তির উপর। নূতন প্রজন্ম শিক্ষা এবং পেশায় অর্জন করবেন সম্মান এবং সাফল্য, এনে দেবেন প্রবাসে জাতির জন্য অকুণ্ঠ সম্মান।

পৃথিবীব্যাপী সব যুদ্ধ ঝামেলা সত্ত্বেও মানুষ আশা ছাড়তে পারে না একটা ভালো আগামীকালের…
সময়ও যেন আমাদের আবার সুযোগ দিছে আরো একটা নতুন বছর নিয়ে এসে…
এই নতুন বছরে যেন সব যুদ্ধ-মহামারীর অবসান হয়ে পৃথিবীতে স্থাপিত হয় চিরশান্তি…
এই আশা নিয়ে আইরিশ বাংলাপোষ্টের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা।

     

SHARE THIS ARTICLE