আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ টান টান উত্তেজনার মধ্যে, ছয় সপ্তাহব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধের ইতি টানতে আজ আরমেনিয়া, আজারবাইজান এবং রাশিয়া একটি ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তিতে উপনীত হয়েছে।
আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাসিনিয়ান ফেসবুকে এক পোস্টে বর্তমান অবস্থানকে “অবর্ননীয় বেদনাদায়ক” হিসেবে ব্যাক্ত করেছেন, এদিকে আজারবাইজানীয় প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ আনন্দ প্রকাশ করে টুইটারে লিখেছেন, “এটি একটি ঐতিহাসিক দিন, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান নাগরোণো-কারাবখ সংঘাতের অবসান ঘটছে। ”
আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভেনে যুদ্ধ বন্ধের এই ঘোষণা, তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। পাসিনিয়ানের ফেসবুক পোস্টের বিশ মিনিটের মধ্যেই প্রতিবাদকারীরা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবী করে রাস্তায় নেমে আসে, প্রতিবাদকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা প্রদান করে।
আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী পাসিনিয়ান গত মঙ্গলবার বলেছিলেন যে তিনি তার সেনাবাহিনীর চাপে শান্তি চুক্তি করছেন, এতে বলা হয়েছে নাগোরানো-কারাবাখের সমস্ত সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ হয়ে গেছে এবং পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
নাগোর্নোকারাবাখের কৌশলগত গুরুত্ত্বপূর্ন শহর সুশা, আজারীয় বাহিনীর করতলগত হয়ে গেলে এবং আজারি বাহিনী কর্তৃক রাশিয়ার হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত করার পর এই ত্রীপক্ষীয় শান্তি চুক্তি হলো।
এই চুক্তির আওতায়, নাগর্নো-কারাবাখ এবং আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী করিডোরের সম্মুখভাগে দ্রুত রাশিয়ার শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হবে। আজারিয় প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ অবশ্য বলেছেন, তুরস্কও এই শান্তি রক্ষা প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে।
আর্মেনিয়ায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া, জনগণ ক্ষোভে আক্রান্ত, যদিও কিছু মানুষ এই শান্তি চুক্তিতে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছেন, তারা ভাবছেন, আর্মেনীয় বাহিনী পর্যুদস্ত হচ্ছিল। এদিকে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে চলছে আনন্দ উৎসব। নাগার্নো কারাবাখ থেকে পালিয়ে আসা অনেকেই তাদের জন্মভূমি নাগার্নো কারাবাখে ফিরে যেতে শুরু করেছেন।
দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বে পর্য্যুদস্ত নাগার্নো কারাবাখ, এই অঞ্চলের জনগন আজ দ্বিধা বিভক্ত আর বিপর্য্যস্ত। আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান উভয় দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ককেশাস অঞ্চলের নতুন সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
১৯৮৯ সালের ২৯ নভেম্বর নাগোরানো-কারাবাখের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান ঘটে এবং অঞ্চলটি আজারবাইজানীয় প্রশাসনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই নীতি ব্যার্থ হয় যখন আর্মেনিয়া সুপ্রিম সোভিয়েত এবং ন্যাশনাল কাউন্সিলের একটি যৌথ অধিবেশন, নাগর্নো-কারাবাখের আইনসভা সংস্থা, আর্মেনিয়ার সাথে নাগরোণো-কারাবাখের একীকরণের ঘোষণা দেয়।
১৯৯১ সালের ২৬ নভেম্বর আজারবাইজান প্রশাসনিক বিভাগকে পুনরায় সাজিয়ে এবং এই অঞ্চলটি তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ১৯৯১ সালের ১০ ই ডিসেম্বর একটি স্থানীয় গণভোট আয়োজন করলে নৃতাত্ত্বিক আজারিরা গণভোট বয়কট করে আর আর্মেনীয়রা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অনুমোদন দেয়। নাগর্নো-কারাবাখের জন্য বর্ধিত স্বায়ত্তশাসনের একটি সোভিয়েত প্রস্তাব উভয় পক্ষই একমত হতে পারেনি এবং পরবর্তীকালে আর্মেনিয়া-নাগর্নো-কারাবাখের মধ্যে পুরো যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
১৯৯১ সাল থেকে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া এই অঞ্চল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে, সেই সময় এই যুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইন্ধন ছিল বিপুল। রাশিয়া আর্মেনিয়ার পক্ষে যুক্ত ছিল। তবে বিপুল জান মালের ক্ষয়ক্ষতির পর ১৯৯৪ সালে একইভাবে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধ বিরতি স্থাপিত হয়। যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও, গত তিন দশক ধরে তথাকথিত “সীমানা রেখা” বরাবর সংঘাত চলছে। সর্বশেষ মারাত্মক সংঘাত ছিল ২০১৬ সালে, যখন উভয় পক্ষের কয়েক ডজন সেনা নিহত হয়েছিল।
এবারে ২৭ শে সেপ্টেম্বর ২০২০ উভয়ের সীমানারেখা থেকে পুনরায় সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয় , ইতিমধ্যে জীবন হানি হয়েছে অনেক, ধ্বংস হয়ে গেছে জনপদ। কয়েকদফা যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘিত হয়েছে। এমতাবস্থায় গুরুত্ত্বপূর্ন শহর শুসা ছিনিয়ে নিয়েছে আজারিরা আর আর্মেনিয়রা এই ক্ষতি স্বীকার করেই আরও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে শান্তি চুক্তিতে বাধ্য হয়েছে।
যুদ্ধ কি শেষ হলো? নাগর্নো কারাবাখ তুমি কার? নাগর্নো কারাবাখবাসীর নাকি আজারবাইজানের নাকি আর্মেনিয়ার? এই সকল প্রশ্নের শেষ উত্তর কি আদৌ মিলবে? ভবিষ্যত কোথায় তা জানতে হলে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।।
তথ্যসূত্রঃ বি বি সি, আল জাজিরা, সি এন এন, ইউরোনিউজ