হাবীবুল্লাহ সিরাজঃ আজ আমাদের সমাজে আল্লাহ প্রদত্ত সেই বিধানকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে নারী সমাজের উপর নেমে এসেছে কালের মহাদুর্যোগ। তাই এখন জরুরি হলো নারীদের সম্পর্কে কুরআন হাদিস কি বলছে সেই বিষয়গুলো আমাদের জানা এবং ওই বিষয়গুলোর উপর আমল করা। যেন কালের যে দুর্যোগ নারী সমাজের উপর নেমে এসেছে তার থেকে দ্রুত উত্তোরণের পথ পাই।
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন নারী হল সতর তথা আবৃত থাকার বস্তু। নিশ্চয়ই সে যখন ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। আর সে যখন গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করে তখন সে আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বেশি নিকটে থাকে। (আলমুজামুল আওসাত, তবারানী)
২. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- ‘ইহরাম গ্রহণকারী নারী যেন নেকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে’। (সহীহ বুখারী ৪/৬৩, হাদীস : ১৮৩৮)
হজরত কাযী আবু বকর ইবনে আরাবী বলেন, নারীর জন্য বোরকা দ্বারা মুখমণ্ডল আবৃত রাখা ফরয। তবে হজের সময়টুকু এর ব্যতিক্রম। কেননা, এই সময় তারা ওড়নাটা চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিবে, চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে না। পরপুরুষ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবে এবং পুরুষরাও তাদের থেকে দূরে থাকবে। (আরিযাতুল আহওয়াযী ৪/৫৬)
৩. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত কাপড় ঝুলিয়ে রাখে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না। তখন উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে নারীরা তাদের কাপড়ের ঝুল কীভাবে রাখবে? রাসূল (সা.) বললেন, এক বিঘত ঝুলিয়ে রাখবে। উম্মে সালামা বললেন, এতে তো তাদের পা অনাবৃত থাকবে। তখন রাসূল (সা.) বললেন, তাহলে এক হাত ঝুলিয়ে রাখবে, এর বেশি নয়। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪১১৭; জামে তিরমিযী ৪/২২৩; সুনানে নাসাঈ ৮/২০৯; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ১১/৮২ ইমাম তিরমিযী (রা.) বলেন, এই হাদীসে নারীর জন্য কাপড় ঝুলিয়ে রাখার অবকাশ দেয়া হয়েছে। কারণ এটিই তাদের জন্য অধিক আবৃতকারী।
৪. ওকবা ইবনে আমের জুহানী (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন তোমরা নারীদের নিকট যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক আনসারী সাহাবী আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! স্বামী পক্ষীয় আত্মীয় সম্পর্কে আপনি কী বলেন? তিনি বললে, সে তো মৃত্যু।
সহীহ বুখারী ৯/২৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২১৭২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৭১; মুসনাদে আহমাদ ৪/১৪৯, ১৫৩
এই হাদীসে বেগানা নারী পুরুষের একান্ত অবস্থানকে নিষেধ করা হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে স্বামী পক্ষীয় আত্মীয়-স্বজন যেমন দেবর-ভাসুর ইত্যাদির সঙ্গে অধিক সাবধানতা অবলম্বনকে অপরিহার্য করা হয়েছে। স্বামী পক্ষীয় আত্মীয় কারা এর ব্যাখ্যা করেছেন রিয়াসুস সালিহীন এর লেখক- স্বামীর পক্ষীয় আত্মীয় হলো স্বামীর ভাই, স্বামীর ভাইয়ের ছেলে, স্বামী চাচার ছেলে।
৫. হজরত আয়েশা (রা.) ইফকের দীর্ঘ হাদীসে বলেছেন- আমি আমার স্থানে বসে ছিলাম এক সময় আমার চোখ দুটি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আসসুলামী ছিল বাহিনীর পিছনে আগমনকারী। সে যখন আমার অবস্থান স্থলের নিকট পৌঁছল তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেল। এরপর সে আমার নিকট এলে আমাকে চিনে ফেলল। কারণ পর্দা বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে তখন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলে ওঠে, যার দরুণ আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে নিজেকে আবৃত করে ফেলি।
অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আমি ওড়না দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি। সহীহ বুখারী ৫/৩২০; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৭৭০; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩১৭৯
৬. উম্মুল মুমিনীন হজরত উম্মে সালামা (রা.) বলেন, আমি একদা রাসূল (সা.)- এর নিকট ছিলাম। উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা রা.ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম উপস্থিত হলেন। এটি ছিল পর্দা বিধানের পরের ঘটনা। তখন রাসূল (সা.) বললেন, তোমরা তার সামনে থেকে সরে যাও। আমরা বললাম, তিনি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখছেন না?! তখন রাসূল (সা.) বললেন, তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখছ না? সুনানে আবু দাউদ ৪/৩৬১, হাদীস : ৪১১২; জামে তিরমিযী ৫/১০২, হাদীস : ২৭৭৯; মুসনাদে আহমাদ ৬/২৯৬; শরহুল মুসলিম, নববী ১০/৯৭; ফাতহুল বারী ৯/২৪৮
৭. উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমরা যখন রাসূল (সা.)- এর সঙ্গে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম তখন আমাদের পাশ দিয়ে অনেক কাফেলা অতিক্রম করত। তারা যখন আমাদের সামনা সামনি চলে আসত তখন আমাদের সকলেই চেহারার ওপর ওড়না টেনে দিতাম। তারা চলে গেলে আবার তা সরিয়ে নিতাম। মুসনাদে আহমাদ ৬/৩০; ইবনে মাজাহ হাদীস : ২৯৩৫
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখা আবশ্যক।
৮. হজরত আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, আমরা পুরুষদের সামনে মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখতাম। মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪। এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, সাহাবা যুগের সাধারণ নারীরাও গায়র মাহরাম পুরুষ থেকে নিজেদের চেহারা আবৃত করতেন। কারণ আসমা বিনতে আবি বকর (রা.) এখানে বহুবচন ব্যবহার করেছেন। যা প্রমাণ করে উম্মুল মুমিনগণ ছাড়া অন্য নারীরাও তাদের মুখমণ্ডল আবৃত রাখতেন।
৯. হজরত ফাতিমা বিনতে মুনযির (রা.) বলেন, আমরা আসমা বিনতে আবু বকর রা.-এর সঙ্গে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতাম। মুয়াত্তা, ইমাম মালেক ১/৩২৮; মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪
১০. হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন- যখনই কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে একান্তে সাক্ষাত করে তখন তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।-জামে তিরমিযী
১১. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলেন, একজন নারী পর্দার পিছন থেকে রাসূল (সা.)-এর হাতে একটি কাগজ দিতে চাইল। রাসূল (সা.) নিজ হাত গুটিয়ে নিলেন (কাগজটি নিলেন না এবং) বললেন, আমি জানি না, এটা কি পুরুষের হাত না নারীর। নারী আরজ করলেন, ‘নারীর হাত।’ নবী কারীম (সা.) বললেন, ‘তুমি যদি নারী হতে তাহলে নিশ্চয়ই নখে মেহেদী থাকত।’ সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ী
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, পীর-মুর্শিদ ও উস্তাদের সঙ্গেও পর্দা করা অপরিহার্য এবং সঙ্গে সঙ্গে এই কথাও বুঝা যায় হাতে মেহেদী বা সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্য রঙ ব্যবহার একমাত্র নারীর জন্য।
অর্থাৎ হজরত উমাইমা বিনতে রুকাইকা রা. থেকে বাইয়াত সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে যে, নারীগণ বললেন, আল্লাহ ও তার রাসূল আমাদের প্রতি আমাদের নিজেদের চেয়েও মেহেরবান। সুতরাং আপনার হাত মোবারক দিন, আমরা বাইয়াত হই। রাসূল (সা.) বললেন, আমি নারীদের সঙ্গে হাত মিলাই না। (যা মুখে বলেছি তা মেনে চলাই তোমাদের জন্য অপরিহার্য)।-মুয়াত্তা মালিক
এই হাদীস থেকে জানা যায়, পীরের সঙ্গে মুরিদের পর্দা করতেই হবে। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! বাইয়াতের সময় তার নবী কারীম (সা.)- এর হাত কখনো কোনো নারীর হাত স্পর্শ করেনি। তিনি শুধু মুখে বলতেন, তোমাকে বাইয়াত করলাম।-সহীহ বুখারী ২/১০৭১
উল্লিখিত হাদিসগুলো সামনে নিয়ে আমরা একথা বলতে পারি যে, আমাদের সমাজ হাদিসে যে পর্দার কথা বলা হয়েছে বা নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে। যার কারণে আমাদের উপর নেমে এসেছে কালের দুর্যোগ। যদি আমরা পর্দার দিকটা একটু খেয়াল করি তাহলে আমাদের মা বোনদের নিরাপত্তার বিষয়টি জোরদার হয়। এখন বলা হচ্ছে নারীর পোশাক ধর্ষণের দায়ী নয়। আমরা বলবো নারীর যে নগ্নতা, নাটক, সিনেমা, গান, ইউটিউব স্যোসাল মিডিয়াতে প্রদর্শিত হয়, ধর্ষণের প্রতি এসব জিনিসও উদ্বোধ্য করে। এগুলো যদি বন্ধ না করা যায়- তাহলে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি পুরুষের মাঝেও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করণ ও নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন দেখাতে হবে।