নিষিদ্ধের ২০ বছরেও বন্ধ হয়নি পলিথিন

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ২০১৯ সালে চার বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প শুরু করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ জন্য চীন থেকে আনা হয়েছিল ‘সাকশন ড্রেজার’। কিন্তু নদীর তলদেশে জমে থাকা পলিথিনের স্তর অত্যাধুনিক এই ড্রেজার দিয়েও সরানো যাচ্ছিল না। পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভৌগোলিক বিশেষজ্ঞদলের গবেষণায় জানা যায়, নদীর তলদেশে দুই থেকে সাত মিটার পর্যন্ত পলিথিন ও প্লাস্টিকের স্তর জমেছে।

কর্ণফুলী বা বুড়িগঙ্গা নদীই নয়, সমুদ্রেও মিলছে পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য। সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বিশালাকৃতির দুটি মৃত তিমি ভেসে আসে। এই তিমি দুটির মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে জানা গেছে, এর অন্যতম কারণ পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তিমির পেটে প্লাস্টিক বর্জ্য গিয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

রাজধানীসহ দেশের সব শহরের খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা আটকে আছে নিষিদ্ধ পলিথিনে। পলিথিন-প্লাস্টিকদ্রব্য ব্যবহারের পর বাসাবাড়ি, প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট থেকে রাস্তাঘাট ও ডাস্টবিনে ফেলা হয়। এরপর তা চলে যাচ্ছে ড্রেন, খাল বা নদীতে। এতে পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, একই সঙ্গে পয়োনিষ্কাশনেও জটিলতা ও জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। মাটির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি চাষাবাদেও বাধা তৈরি করছে এই পলিথিন।

এ পরিস্থিতির মধ্যে আজ শনিবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২১’। এবার জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’। এ ছাড়া ‘প্রকৃতি সংরক্ষণ করি, প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি’ এই স্লোগানে দিবসটি পালনের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। দিবসটি উপলক্ষে ‘মুজিববর্ষে অঙ্গীকার করি, সোনার বাংলা সবুজ করি’ প্রতিপাদ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে চারটি গাছের চারা রোপণ করে ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ২০২১’-এর শুভ উদ্বোধন করবেন।

প্রায় ২০ বছর আগে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এর পরও বন্ধ হয়নি ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যবহার। বরং বেড়েই চলেছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে শপিং মলে অবাধে চলছে এর ব্যবহার। খাবারের হোটেল, চাল, ডাল, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে সবজি বেচাকেনায় ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন।

বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর প্রেক্ষিতে পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। ২০০২ সাল থেকে তিন-চার বছর পলিথিনের ব্যবহার সীমিত হলেও বর্তমানে যত্রতত্র অবাধে ব্যবহার হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লকডাউন শেষ হলেই পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে আমাদের অভিযান জোরদার করব। তবে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা খুব প্রয়োজন। এ ছাড়া পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কী ব্যবহৃত হতে পারে সে ব্যাপারেও আমাদের কাজ করতে হবে।’

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য মতে, রাজধানীসহ দেশজুড়ে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় এক হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার অলিগলিতে রয়েছে অন্তত ৩০০ কারখানা। কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীর চর, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে আরো শতাধিক কারখানা। এসব কারখানা থেকে সারা দেশে সরবরাহ করা হয় পলিথিন। বিশ্বের ১৯৩টি দেশের প্ল্যাটফর্ম আর্থ ডে নেটওয়ার্কের এক গবেষণায় জানা যায়, পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম।

সূত্র জানায়, সরকার পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন নিষিদ্ধ করলেও ৫৫ মাইক্রোনের অধিক পলিথিনজাতীয় পণ্য বা মোড়ক উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনুমোদিত কাঁচামাল আমদানি করে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে। অনুমোদিত কারখানার মালিকরা ছোট কারখানাগুলোর কাছে কাঁচামাল বিক্রি করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাঁচামালগুলো রিসাইকেল করে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ তৈরি হচ্ছে।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০০২ সালে যখন পলিথিন বন্ধ করা হয়, তখন থেকে কিন্তু তিন-চার বছর এর ব্যবহার কম ছিল। তবে এরপর যথাযথ বাজার তদারকির অভাব ও বিকল্প কিছু দিতে না পারায় ফের পলিথিন ফিরে এসেছে। এই পলিথিনের লাইফটাইম ২০০ থেকে ৩০০ বছর। দীর্ঘ সময়েও আমরা পলিথিনের বিকল্প কিছু দিতে পারিনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘পলিথিন জলাবদ্ধতার পাশাপাশি মাটির উর্বরতা হ্রাস করছে। এটা না পচলেও এর অণুগুলো ভেঙে যায়, যা মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে থাকে। আর বিভিন্ন ফল ও মাছের মাধ্যমে আমাদের শরীরে যায়, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমাদের গবেষণায় ধানমণ্ডি লেক ও বুড়িগঙ্গার মাছে পলিথিনের অণু পেয়েছি। এ ছাড়া ২০১৯ সালে এক গবেষণায় দেখেছি, উপকূলীয় এলাকায় ৪২ কিলোমিটার সময়াতন পানিতে প্লাস্টিক বর্জ্য ভাসমান আছে।’

কেন পলিথিন ব্যবহার করছেন এর উত্তর দেন মিরপুর-১৪ নম্বরের মুদি দোকানদার মো. বিপুল। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘১০০ কাগজের ঠোঙা দুই শ থেকে তিন শ টাকায় কিনতে হয়। অন্যদিকে এক কেজি পলিথিন কেনা যায় ১৫০ টাকায়। এতে দুই শ থেকে আড়াই শ পলিথিন হয়। প্রথমত, পলিথিনের দাম কম, বহন করা সহজ। ক্রেতারা পলিথিনে পণ্য নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।’

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে ধান, চাল, ভুট্টা, সার, চিনিসহ ১৯টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন কিছু অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু পরে সেই উদ্যোগের আর সুফল মেলেনি। বাংলাদেশি বিজ্ঞানী পলিথিনের বিকল্প ‘সোনালী ব্যাগ’ উদ্ভাবন করলেও দীর্ঘদিনেও এর বাণিজ্যিক ব্যবহার সম্ভব হয়নি।

SHARE THIS ARTICLE