
আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ শান্তিতে নোভেল বিজয়ী আয়ারল্যান্ডের প্রাক্তন সোশাল ডেমোক্রেট এন্ড লেবার পার্টি (SDLP) প্রধান জন হিউম ৮৩ বছর বয়সে গতকাল সকালে মৃত্যুবরণ করেন। জন হিউম ছিলেন উত্তর আয়ারল্যান্ডে স্থাপিত শান্তির অন্যতম রূপকার এবং আয়ারল্যান্ডের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের পুরোধা। জন হিউম ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের একজন প্রাক্তন সদস্য। জন হিউম, এস ডি এল পি দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে দীর্ঘ ২২ বছর এই দলের নেতৃত্ব দেন । হিউম ছিলেন ১৯৬০ সালের শেষদিকে আয়ারল্যান্ডে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা এবং তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে অহিংসতার নীতিতে ছিলেন অবিচল। জন হিউম ১৯৩৭ সালের ১৮ই জানুয়ারি উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেরী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। পাদ্রী হিসেবে কাজ করার উদ্দেশ্যে তিনি সেন্ট কলাম্ব’স কলেজ ও পরবর্তীতে মেয়নুথের সেন্ট পেট্রিক্স কলেজে পড়ালিখা করেন, স্নাতকোত্তর শেষে তিনি পাদ্রী হওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে, ডেরিতে ফিরে আসেন এবং শিক্ষকতা শুরু করেন। �১৯৬০ সালে নাগরিক অধিকার আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে অগ্রণী থেকে সোশাল ডেমোক্রেটিক এন্ড লেবার পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৭৯ সালে দলপ্রধান নির্বাচিত হন।১৯৬৯ সালে তিনি স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদী হিসেবে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৩ সালে এসেম্বলি সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭৪ এবং ১৯৮৩ সালে তিনি ওয়েস্ট মিনিস্টারের সদস্য নির্বাচিত হন। �হিউম তার নাগরিক অধিকার আন্দোলনে অন্যায় এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথে আয়ারল্যান্ডের দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তি করে ঐক্য স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। এই লক্ষ্যে তিনি ব্রিটিশ সরকার এবং সিন ফেন দলের সাথে গোপন আলোচনার মাধ্যমে রিপাবলিকান দলকে খোলামেলা আলোচনায় আসতে উদ্বুদ্ধ করেন। ভীষণ সমালোচনা ও তীব্র বিরোধিতার মধ্যেও তিনি সিন ফেনের সাথে শান্তির লক্ষ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখেন। এক সময় তিনি বলেছিলেন, “রাজনীতি হচ্ছে যুদ্ধের বিকল্প” । ১৯৮৫ সালে এংলো আইরিশ চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে অব্যাহত কার্য্যক্রমে তার অবদান ছিল অসামান্য। বৃহত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঝুঁকি নিয়েই তিনি ১৯৯৪ সালে সিন ফেন প্রধান গেরি এডামসের সাথে সরাসরি আলোচনায় বসেন। এই আলোচনার পথ ধরেই ঐতিহাসিক ডাউনিং স্ট্রিট ঘোষণায় আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়, শান্তি অর্জনে এই অস্ত্র বিরতি ছিল মাইলফলক। এই শান্তিচুক্তির ১৭ মাস পর লন্ডনের ডকল্যান্ডে বোমা বিস্ফোরিত হলে যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ে।
যদিও আই আর এ সহিংস পথে ফিরে যায় কিন্তু জন হিউম, সিন ফেন ছাড়াই ১৯৯৬ সালের বহুদলীয় সংলাপ অব্যাহত রাখেন। পরের বছর টনি ব্লেয়ারের শ্রমিক দল ক্ষমতায় আরোহন করলে আধাসামরিক অস্ত্র প্রত্যাহারে বহুদলীয় সংলাপ অব্যাহত রাখেন। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি অস্ত্রবিরতি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করলে বহুদলীয় আলোচনায় সিনফেনকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করতে তারা রাজী হন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে অস্ত্র বিরতি ঘোষিত হয় এবং এর ২ মাস পর সর্বদলীয় সংলাপে সিন ফেন দলকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা অব্যাহত থাকে। এসকল পদক্ষেপে জন হিউমের ভূমিকা ছিল গুরুত্ত্বপূর্ন। এই পদক্ষেপ হিউমের দীর্ঘ প্রত্যাশিত সহিংসতা সম্পুর্ন বন্ধ করতে সক্ষম না হলেও শত শত জীবন সুরক্ষিত হয়। জন হিউম তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে কার্য্যক্রম অব্যাহত রাখেন, যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৮ সালের ১০ই এপ্রিল বেলফাস্টে ঐতিহাসিক গুড ফ্রাইডে চুক্তি সম্পাদিত হলে বৃহত্তর শান্তি অর্জিত হয়। এই সময়টা জন হিউমের জীবনের সফলতার অভিষেকের সময় ছিল, তার ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠা ব্যাতীত এই চুক্তিতে পৌঁছানো কঠিন হতো একথা সকলেই মনে করেন। ১৯৯৮ সালে তাকে ও আলসটার ইউনিয়নিস্ট নেতা ডেভিড ট্রিম্বলকে যৌথভাবে নোভেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়।
১৯৯৯ সালের আগস্টে অস্ট্রিয়ায় একটি সম্মেলন চলাকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নীত হন। এর পর ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। ২০০১ সালে ২২ বছর দলীয় প্রধান থাকার পর অসুস্থতার কারনে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি ডেমেনশিয়া রোগে ভুগতে শুরু করেন। ২০১৮ সালে গুড ফ্রাইডে চুক্তির ২০তম বার্ষিকি স্মরণ সভায় তার স্ত্রী বলেন, ”তার স্মৃতিতে আর গুড ফ্রাইডে চুক্তি কিংবা সানিংডেইল চুক্তি কিংবা কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই কিন্তু তার সকল প্রচেষ্টার ফসল অর্জিত হয়েছে সেটা আনন্দের। তিনি খুশী আছেন আনন্দিত আছেন” �তাকে গান্ধী পুরষ্কার এবং মার্টিন লুথার কিং পুরষ্কারেও ভূষিত করা হয়। ২০১০ সালে আয়ারল্যান্ডের জাতীয় রেডিও আর টি ই কর্তৃক অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনে তাকে, “আয়ারল্যান্ডের সর্বষ্রেষ্ঠ ব্যাক্তি” হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। ২০১৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেন, ”এই ডেরি শহর, অহিংসতা অর্জনে জন হিউমের অব্যাহত নিরলস ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং অন্যান্য সকল দলের বিশেষ করে সিন ফেনের সহযোগিতা শান্তি অর্জনের মূল অনুপ্রেরণা ছিল। আমি সবাইকে অনুরোধ করি বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের প্রয়োজনে জন হিউমের মত নেতাদের বিসর্জনের কাড়নে হলেও- এই কাজটিকে সমাধা করুন, সম্পুর্ন করুন।” ��দীর্ঘ, সফল এবং অনন্যসাধারণ জীবনের অবসান হয় গতকাল। পূর্ণ আয়ারল্যান্ড দ্বীপটির অধিবাসী জনগণ তার অবদানের কথা স্মরণ রাখবে দীর্ঘদিন। ১৯৬০ সালে থেকে অশান্তি, দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, বিগ্রহের কারণে আইরিশ জনগণ যে অশান্তি আর কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতেন তা আজ অবসান হয়েছে। আয়ারল্যান্ড এখন একটি শান্তি পূর্ন দেশের নাম আর এই দেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বে এক ইতিবাচক অবস্থানে অধিষ্টিত। এই শান্তি ও প্রগতির রূপকার ছিলেন এই রাজনীতিবিদ জন হিউম। ��সূত্রঃ আইরিশ টাইমস, জার্নাল.আই ই, আর টি ই