পরিবর্তন হচ্ছে পুলিশের পোশাক ও লোগো

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ছাত্র আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত টানা আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনার মুখে এই বাহিনীর পোশাক ও লোগো পরিবর্তনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি পুলিশ পরিচালনায় স্বাধীন একটি কমিশন গঠনেরও সিদ্ধান্ত এসেছে। আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়।

গত রোববার বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই বৈঠক হয়। বৈঠক থেকে গতকাল সোমবার সব পুলিশ সদস্য তাদের ডিউটিতে যোগ দেওয়ারও সিদ্ধান্ত জানান। এরই মধ্যে গতকাল রাত থেকে তারা প্রতীকীভাবে যোগদানও করেন। বৈঠক সূত্র জানায়, ১১ দফা দাবিতে আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যরা নিরাপদ পরিবেশে কর্মস্থলে যাতায়াত, ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তন, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা অনুযায়ী পদায়ন, আন্দোলনে নিহত পুলিশ সদস্যদের ক্ষতিপূরণ, বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ওসিদের পদায়নের দাবি তোলেন। এই বৈঠকের আগে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।

বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের ইউনিফর্ম, লোগো সব পরিবর্তন করা হবে। পুলিশের অনেকের মন ভেঙে গেছে। এই ইউনিফর্ম পরে

পুলিশ আর কাজ করতে চাইছে না। খুব দ্রুতই তা পরিবর্তন করা হবে। এসব বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বৈঠক শেষে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ক পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম ও কনস্টেবল শোয়েবুর রহমান। তারা বলেন, আমরা সরকারের কাছে যেসব দাবি জানিয়েছিলাম, তার বেশিরভাগই মেনে নেওয়ার আশ্বাস পেয়েছি। তাই কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিচ্ছি। তারা আরও বলেন, খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। দ্রুত পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। পুলিশ নিয়ে স্বাধীন একটি কমিশন হওয়ার ব্যাপারেও ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মশিউর রহমান, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন, আইজিপি ময়নুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মইনুল হাসান এবং মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, পুলিশের ১১ দফা দাবির কয়েকটি অল্প সময়ের মধ্যে পূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। অন্য দাবিগুলো পূরণ করা হবে দীর্ঘ মেয়াদে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে।

এর আগে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে পুলিশ সদস্যদের নিজ নিজ দায়িত্বে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন। তিনি জানিয়েছিলেন, পুলিশের যেসব সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, তাদের জন্য শেষ সময় হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার। এই সময়ের মধ্যে কেউ যোগ না দিলে ধরে নেওয়া হবে, তারা চাকরিতে ইচ্ছুক নন।

দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘পুলিশের গায়ে যেন অহেতুক কেউ হাত না দেয়। ছোট, বড় অপরাধ যাই হোক, তাদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচারের আওতায় আনা হবে। ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ করা যাবে না। জনগণকে আমি এটুকু বলতে চাই, আপনারা পুলিশের গায়ে হাত দেবেন না। আপনারা দেখছেন, আপনারা নিজেরাই সাফার করছেন।’

গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর শেখ হাসিনা দেশ ছাড়লে দেশজুড়ে থানাসহ পুলিশের স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে। ভাঙচুর ও লুটপাটও করা হয় অনেক থানায়। এসব ঘটনায় হতাহত হন অনেক পুলিশ সদস্য। নিরাপত্তাহীনতা ও সহকর্মীদের হতাহত হওয়ার ক্ষোভ থেকে ৫ আগস্টের পর কাজে যোগ দেননি পুলিশের ননক্যাডার সদস্যরা। অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়েও গেছেন। ফলে ঢাকার রাস্তাঘাট এবং থানাগুলো কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে নিরাপত্তাসহ ১১ দফা দাবিতে ৬ আগস্ট থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন ননক্যাডার পুলিশ সদস্যরা। পুলিশহীন রাজধানীতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে নামানো হয় আনসার সদস্যদের। শিক্ষার্থীরাও পালন করছেন এই দায়িত্ব। তবে ৬ দিন পর পুরোদমে পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

গত রোববার পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, বিকেল ৩টা পর্যন্ত সারা দেশের মোট ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৯৯টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মেট্রোপলিটনের ১১০টি থানার মধ্যে ৯৭টি এবং জেলার ৫২৯টি থানার মধ্যে ৫০২টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এদিন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম জানিয়েছেন, ট্রাফিক পুলিশও প্রস্তুত আছে। অল্পসংখ্যক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছেন। পুলিশপ্রধানের দেওয়া এই তথ্যের পর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর গুলশান এলাকার কয়েকটি সড়কে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন শুরু করেছে।

গত রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রাতে রাতে আমার কাছে টেলিফোন আসে, অমুক জায়গায় ডাকাতি হয়েছে। যদি ডাকাতি হয়, সেখানে যদি পুলিশ না থাকে কী করবে?’

ইসলামী ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে হামলা ও গুলির ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘চেষ্টা করছি যাতে পুলিশ ফিরে আসে, যদি না ফেরে, আপনারা দেখছেন কী হতে পারে। একটু আগে দেখলাম ব্যাংকে মারামারি হইছে, ব্যাংক দখল করবে। এখন মনে হয় যে যার মতো করে যা দখল করতে পারে।’

এর আগে রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের সামনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিগত সরকারগুলোর আমলে বাংলাদেশে পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। পুলিশকে এই অস্ত্র দেওয়া ঠিক হয়নি। পুলিশ বাহিনীকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো এভাবে ব্যবহার করা যাবে না। পুলিশ চলবে পুলিশ কমিশনের অধীনে। এই পুলিশ জনগণের পুলিশ।’

এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলন ঘিরে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তাতে পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছে। পুলিশকে যারা ব্যবহার করেছে, আপনারা তাদের ধরুন। আমি চেষ্টা করব হুকুমদাতাদের ধরতে। কারা পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করেছে, তাদের উদ্দেশ্য কী, এটাও খুঁজে দেখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আবার পুলিশও কিছুই করেনি, বিষয়টি এমন নয়। একজনকে গুলি করে মারা, আরেকজনকে মাথার চামড়া তুলে ফেলা বা হাত-পা টুকরো করে ফেলা, মাথা থেঁতলে দেওয়া, এটা তো আপনি কারও সঙ্গে করতে পারেন না। এমনকি যুদ্ধের সময় একজন মৃত সৈনিককে এভাবে থেঁতলে দিই না। এটা দুঃখজনক। এটাও দুঃখজনক যে হাজার তরুণ মারা গেছে পুলিশের গুলিতে।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থী রাস্তায় ট্রাফিকের কাজ করছে, তাদের তালিকা করে সবাইকে পুলিশের পক্ষ থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। এই সার্টিফিকেট চাকরি ক্ষেত্রে যেন মূল্যায়ন হয়। শিক্ষার্থীরা নিজের টাকায় সড়কে কাজ করছে, সড়ক পরিষ্কার করছে, রং কিনে দেয়াল সুন্দর করছে। এটা যদি সরকারি প্রজেক্ট হতো তাহলে হাজার কোটি টাকা লাগত। একটা দেশে এর চাইতে ভালো উদাহরণ হতে পারে না।’

SHARE THIS ARTICLE