আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নাটকীয় মোড় নিয়েছে, যার মূল ভূমিকায় যুক্ত দেশটির সর্বোচ্চ আদালত।গত মঙ্গলবার আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান আধা-সামরিক বাহিনী রেঞ্জার্সের সদস্যরা। গ্রেপ্তারের পর নজিরবিহীন এক আদেশে সেই গ্রেপ্তারকেই অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট।
বৃহস্পতিবার (১১ মে) পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ রায় দেন— আদালত থেকে ইমরানকে গ্রেপ্তার করার বিষয়টি ‘অবৈধ।’ প্রধান বিচারপতির এমন রায়ের পর ইমরানের দল তেহরিক ই-ইনসাফের কর্মীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
ইমরান খানের গ্রেপ্তারের বিষয়টি ‘অবৈধ’ ঘোষণা করায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তার সাবেক স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথও। এক লাইনের টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, অবশেষে বোধ জয়ী হলো।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন বর্তমান ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সদস্য ও সরকারের মন্ত্রীরা।
ইমরানের গেপ্তারকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় পিএমএল-এনের প্রধান আয়োজক মরিয়ম নওয়াজ প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের সমালোচনা করেছেন।
তিনি উমরকে প্রধান বিচারপতির পদ ছেড়ে ইমরানের দল তেহরিক ই-ইনসাফে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি একজন ফিতনার ঢাল হিসেবে কাজ করছেন এবং আগুনে ঘি ঢালছেন। আপনার প্রধান বিচারপতি পদ ছেড়ে পিটিআইয়ে যোগ দেওয়া উচিত, যেমনটি করেছেন আপনার শাশুড়ি।’
পাকিস্তানের পরিকল্পনামন্ত্রী আহসান ইকবালও প্রধান বিচারপতিকে কটাক্ষ করে টুইট করেছেন। তিনি টুইটে লিখেছেন, ‘২০১৮-২২ সাল পর্যন্তও যদি এই সুপ্রিম কোর্ট থাকত’।
এই সময়টায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরান খান। তার আমলে দুর্নীতির অভিযোগে অনেক বিরোধী দলীয় নেতাকে আটক করা হয়। এ বিষয়টিকেই ইঙ্গিত করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আহসান।
অন্যদিকে, এক ভিডিও বার্তায় পিটিআই সিনেটর আজম স্বাতী বলেছেন, আইনের চোখে সবাইকে সমানভাবে বিচার করা হলেই কেবল একটি দেশ সফলতা অর্জন করতে পারে। একটি দেশ আইন অনুযায়ী চললে কেউই আইনের উর্ধ্বে থাকতে পারবে না।
তবে সরকারের মন্ত্রীদের কেউ আবার ইমরান খানের সঙ্গে আদালতের সখ্য আছে বলে কটাক্ষ করেছেন। ইমরানকে গ্রেপ্তার ঘিরে যে সহিংসতা চলেছে তাতে আহত পুলিশ সদস্যরা যদি ন্যায়বিচার না পান, পক্ষান্তরে ওই ব্যক্তি যিনি তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন, তিনি ছাড় পেলে দেশ কেবলই জ্বলবে বলে ভাষ্য তাদের।
আবার পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর জন্যও আদালতের এই রায় এক ধাক্কা। পাকিস্তানের সরকার সাধারণত প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর সমর্থন খোঁজে। সেনাবাহিনী ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশটি শাসন করেছে।
দেশটিতে তিনবার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইমরানের অভিযোগের নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এক বিরল বিবৃতি ইস্যু করার পরই ইমরান খান গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এখন তিনি ছাড় পাওয়ায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতই আরও বাড়ার পট প্রস্তত হল।
সুপ্রিম কোর্ট বৃহস্পতিবার ইমরান খানকে এক ঘণ্টার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে হাজির করার নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশ আসে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে পিটিআই এর করা আবেদনের শুনানি চলার সময়।
এরপর একঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের মধ্যে ইমরান সুপ্রিম কোর্টে হাজির হলে শুনানির পরপরই অপ্রত্যাশিত আদেশে তার গ্রেপ্তারের পদক্ষেপকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালত।
গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাই কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে আল কাদির ট্রাস্ট মামলায় ইমরানকে নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তার করেছিল পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো-এনএবি। এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে এ আবেদনের শুনানি চলাকালে ইমরানকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা দেশের বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য অসম্মানের বলে প্রধান বিচারপতি উমর আতা বন্দিয়াল মন্তব্য করার পর ইমরানকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয় ন্যাশনাল একাউন্টেবিলিটি ব্যুরোকে (এনএবি)।
সুপ্রিম কোর্টের লিখিত আদেশে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তা ‘অকার্যকর এবং বেআইনি’। আদালতের ‘পবিত্রতা এবং নিরাপত্তা’ লঙ্ঘন ছাড়াও এভাবে গ্রেপ্তার করে পিটিআই চেয়ারম্যানের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারও লঙ্ঘন করা হয়েছে।
পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল তার আদেশে আরও বলেছেন, শুক্রবার ফের ইসলামাবাদ হাই কোর্টে হাজির হবেন ইমরান খান। পুলিশ লাইন্সের অতিথিশালায় একজন অতিথি হিসাবেই তিনি থাকবেন। তাকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বভার থাকবে সরকারের ওপর।
গত বুধবার ইমরানকে ইসলামাবাদের পুলিশ লাইনসে স্থাপন করা একটি অস্থায়ী আদালতে তোলা হয়েছিল। সেখানে এনএবি ইমরানের ১৪ দিনের জন্য রিমান্ডে চেয়েছিল। পরে আদালত আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
রিমান্ডে পাঠানোর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ইমরান ছাড়া পেলেন, যা এ যাবতকালের সবচেয়ে দ্রুত ছাড় পাওয়ার ঘটনা। যদিও ইমরান খানকে ছাড় দিলেও তাকে এখনও বাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি। কখন দেওয়া হবে তাও এখনও স্পষ্ট নয়।
তবে ইমরানকে গ্রেপ্তার ঘিরে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, আদালতের রায়ের পর তা আপাতত নিভেছে। বৃহস্পতিবার মাঝে মাঝে দু’একটা বিক্ষোভ ছাড়া রাস্তাঘাট অনেকটাই ছিল শান্ত। তবে পিটিআই এখনও সতর্ক রয়েছে। শুক্রবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টে যাবে বলে জানিয়েছে তারা।