পিয়াসা-মিশু চক্রের হাতে কত টাকা আছে তার অনুমান করাও দুষ্কর

আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ চট্টগ্রামের মেয়ে বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। অভিযোগ আছে, দিনে ঘুমান আর রাতে রাণী হন নানা বিত্তবানের। রাত হলে বিলাসবহুল বিএমডব্লিউটি মার্সিডিজ ব্রান্ডের গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে চলতেন রাজধানীর বার ও নাইট ক্লাবের উদ্দেশে। অনেকটা খোলামেলা পোষাকে ঢুকে পড়তেন সেখানে। প্রভাবশালী আর ধনীর দুলালদের সঙ্গে চলতো ডিসকো ড্যান্স। গ্রুপ বেধে সেবন করতো মাদক। পরে চলে যেতো রাজকীয় ফ্ল্যাটে।

আলোচিত রেইন ট্রি হোটেলের ঘটনায় নাম আসে এই পিয়াসার। সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়ে যান। পরে মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনাতেও মামলার এজহারে নাম আসে তার। এবার ডিবির অভিযানে গ্রেপ্তারের পরও ফের আলোচনায় আসেন পিয়াসা।

ফেরারি, ল্যাম্বারগিনি, পোরশে, মাজদা। অভিজাত এবং বিলাসবহুল এসব গাড়ির দাম আকাশছোঁয়া। চাইলেও যে কেউ এসব গাড়ির মালিক হতেও পারে না। কারণ এসব গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি নিষিদ্ধ। কিন্তু ডিবির হাতে গ্রেফতার বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা চোরাইপথে এসব গাড়ি আনতেন ঢাকায়। ক্রেতার অভাব হয়নি। কারণ উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তাকে গাড়ি বিক্রিতে বেগ পেতে হয়নি।

তবে পিয়াসার চোরাচালান চক্রের প্রধান সহযোগী মিশু হাসান নামের এক যুবক। চোরাচালানের সুবাদে তিনিও এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। রাজধানীর উপকণ্ঠে সান ডেইরি নামের একটি গরুর ফার্মের আড়ালে তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাদক ও অস্ত্রের কারবারে জড়িত। মিশু এক সময় রাজধানীতে পেশাদার ছিনতাইকারী হিসাবে পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিলেন।

সূত্র জানায়, পিয়াসা ডিবির হাতে গ্রেফতারের পর মিশু হাসানকেও আটক করা হয়েছে। আজ এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে।

পিয়াসা-মিশু চক্রের হাতে কত টাকা আছে তার অনুমান করাও দুষ্কর। কারণ ডেইরি সান নামের ফার্মে বিদেশি গরু লালন পালনের আড়ালে তাদের চোরাচালান কৌশলের কাছে হার মানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি। বিদেশ থেকে আমদানির সময় গরুর পেটে করে আনা হয় হীরা ও স্বর্ণের চালান। গত ৫ বছরে এভাবে হাজার কোটি টাকার চালান দেশে আনা হয়।

সূত্র বলছে, শুধু হীরার এবং স্বর্ণের চালান নয়, গরুর পেটে করে ইয়াবার চালানও আনা হয়। এজন্য মাঝে মাঝে টেকনাফ থেকেও গরুর চালান আনা হতো। এভাবে চোরাচালানের টাকায় রাতারাতি বিত্তশালী বনে যান মিশু। তার অভিজাত এবং শৌখিন জীবনযাপন অনেক মধ্যপ্রাচ্যের যুবরাজদের মতো। তিনি হাতে পিজিয়েট ব্রান্ডের ঘড়ি পরেন। হিরাখচিত পিজিয়েট ঘড়ির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য কোটি টাকা। মিশুর ব্যবহৃত জুতার ডিজাইন করা হয় দুবাই এবং সিঙ্গাপুরে। তিনি আগে মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই করতেন। ছিনতাইয়ের অভিযোগে একাধিকবার পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হন। জেলে ছিলেন ৩ মাস। পরে পরিবারের এক সদস্যের গয়না বেচে মিশুকে জেল থেকে ছাড়ানো হয়।

সূত্র বলছে, মিশু এক সময় নিজেকে প্রয়াত সংসদ সদস্য হাজি মকবুলের ছেলে মাসুদের বন্ধু বলে পরিচয় দিতেন। ফলে মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের লোকজন তার ওপর গুলি চালায়। হেলালের অনুগত কিলার হিসাবে পরিচিত লাল্লুর গুলিতে আহত হন মিশু। এখনো তার শরীরে গুলির দাগ রয়েছে।

সূত্র বলছে, মিশুর মাধ্যমে ইয়াবা, হিরা এবং সোনার চালান আনা হলেও বিক্রির মূল কাজটা করেন পিয়াসা নিজেই। এ জন্য তিনি ডার্ক ওয়েব এবং ফেসবুক চ্যাটিং গ্রুপ ব্যবহার করতেন। মিশুর মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্রের চালানও আনা হয়। পিয়াসার ইয়াবার মূল ক্রেতা ছিলেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পড়ুয়া ধনী পরিবারের সন্তানরা।

রাজধানীর গুলশান থেকে ফেরারি ব্রান্ডের একটি অভিজাত প্রাইভেট উদ্ধার করা হয়েছে। এফ-৪৩০ সিরিয়ালের ৬ হাজার সিসির গাড়িটি গুলশানের ১১১ নম্বর রোডে অবস্থিত অটো মিউজিয়ামে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছিল। এ ধরনের উচ্চ সিসির গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি নিষিদ্ধ। এ কারণে বৈধভাবে রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই। তবে এ ধরনের গাড়ি রাজধানীর রাস্তায় চলছে ভূরি ভূরি। সবগুলোর নম্বর প্লেট ভুয়া। মঙ্গলবার অটো মিউজিয়াম থেকে উদ্ধারকৃত গাড়িটিতেও একটি নম্বর প্লেট লাগানো ছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে নম্বরটি জাল।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি উদ্ধার অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে এই প্রতিবেদক উপস্থিত ছিলেন। লাল রঙের চকচকে ফেরারি গাড়িটির আমদানি সংক্রান্ত কাগজপত্র চাওয়া হলে তা দেখাতে ব্যর্থ হন শোরুম কর্তৃপক্ষ। এক পর্যায়ে গাড়িটি জব্দ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অটো মিউজিয়ামের ম্যানেজার বাবু বলেন, গাড়িটি বিক্রির জন্য এখানে একজন রেখে যান। এর বেশি কিছু আমরা জানি না। অটো মিউজিয়ামের মালিকের নাম হাবিবুল্লাহ ডন। তিনি গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার দু’বার সভাপতি ছিলেন। শোরুম থেকে চোরাই গাড়ি উদ্ধারের ঘটনায় হাবিবুল্লাহ ডনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।

এদিকে সূত্র জানায়, ফেরারি উদ্ধারের পর ল্যাম্বারগিনি ব্রান্ডের আরেকটি গাড়ি উদ্ধারে অভিযান চলছে। ৬ সিলিন্ডারের ল্যাম্বারগিনি বিশ্বের মূল্যবান ব্যক্তিগত গাড়ির মধ্যে অন্যতম। অভিজাত এসব গাড়ির দরজা ঈগলের ডানার মতো। দুপাশ দিয়ে খোলার বদলে খোলে আড়াআড়িভাবে। দরজা খোলা অবস্থায় পার্কিং করা হলে ল্যাম্বারগিনি অনেকটা উড়ন্ত ঈগলের মতো দেখায়।

অভিনব কৌশলে পিয়াসা-মিশু চক্র চোরাই ল্যাম্বারগিনি বিক্রি করে আসছেন। এজন্য গোপন চ্যাটিং গ্রুপ খুলে প্রথমে গাড়ির লোগো পোস্ট করা হয়। এরপর দেওয়া হয় একটি দরজার ছবি। এরপর রংসহ গাড়ির অন্য অংশগুলো। এভাবে গাড়ি সম্পর্কে ক্রেতার আকর্ষণ চরমে পৌঁছলে গাড়ির সম্পূর্ণ ছবি পাঠানো হয়।

এ দিকে গুলশান, বনানী ও বারিধারার মতো অভিজাত এলাকার ২০-২৫টি বাসায় প্রতি রাতে আয়োজিত ‘নাইট পার্টি’তে অংশ নেওয়া বিভিন্ন মডেলই একসময় বড় এক চক্রের সদস্য হয়ে পড়েন। পার্টিতে অংশ নেওয়া ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের অসতর্ক অবস্থার ছবি কৌশলে তুলে রাখতেন তারা। পরে এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া এবং স্বজনদের কাছে পাঠানোর ভয় দেখিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করতেন মডেলরা।

পুলিশ বলছে, এই চক্রের সদস্য হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিলেন মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ এবং অভিনেত্রী শিলা হাসান। মাদক মামলায় পিয়াসা ও মৌকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে জব্দ ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও অন্যান্য আলামত পরীক্ষা করে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তবে শিলা হাসান এখনও অধরা রয়েছেন।

উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা জানান, নাইট পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসেবে এমন ১০-১১ জনের নাম পাওয়া গেছে, যারা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান।

SHARE THIS ARTICLE