প্রতারক সাহেদের ‘লেডি ভার্সন’ কে এই লুপা?

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে অপহৃত ৯ বছরের শিশু ফুলবিক্রেতা জিনিয়াকে নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধারের পরই আলোচনায় আসে নূর নাজমা আক্তার লুপা তালুকদার ওরফে লুপা বেগম নামে এক নারীর নাম।
তার পরিচয়, তিনি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। বাংলাদেশ আওয়ামী পেশাজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক। পরিধান করেন  মুজিব কোট। পেশা তার সাংবাদিকতা! বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তার ছবি ভাসছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে এসব পরিচয়ের পুরোটাই তিনি ব্যবহার করেন প্রতারণা করতে। অপর সূত্র বলছে, তথাকথিত মানবাধিকার  কর্মী হিসেবেও পরিচয় দিতো লুপা।

জিনিয়া 'অপহরণকারী' কে এই লোপা তালুকদার? | Silkcity News

সাংবাদিকতার মুখোশের আড়ালে লুপা তালুকদার বিভিন্নভাবে নারীদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক কাজে বাধ্য করতো পাশাপাশি পথশিশুদের অপহরণ করে পতিতালয়ে বিক্রির অভিযোগও আছে এই বহুরুপী প্রতারকের বিরুদ্ধে। ফেসবুকে নিজেকে একটি গণমাধ্যমের এমডি পরিচয় দিলেও বাস্তবে সেই গণমাধ্যমের কোন অস্তিত্বই পাওয়া যায় নি। এছাড়াও লুপা তালুকদার ফেসবুকে নিজেকে আওয়ামী পেশাজীবী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক দাবি করলেও আদতে এই নামে আওয়ামী লীগের কোন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনই নেই।

শিশু 'অপহরণকারী' কে এই লোপা তালুকদার?

সাংবাদিক পরিচয়ের প্রভাব খাটিয়ে প্রভাবশালীদের তদবিরে ইতিমধ্যে তিনি হত্যা মামলা থেকেও খালাস পেয়েছেন। সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে গড়ে তুলছেন সখ্যতা।

জানা গেছে, লুপা নারী ও শিশু পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত। আওয়ামী পেশাজীবী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতা ও সিনিয়র সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তিনি দাপটের সাথে চলাফেরা করেন এবং নানা অপকর্ম চালিয়ে যান। তিনি অনেকের কাছেই পরিচিত মুখ। সমাজের  উঁচু স্তরের মানুষের সঙ্গে ছবি রয়েছে এই লোপা তালুকদারের। বড় বড় নেতা-মন্ত্রী, এমপির সঙ্গেও ছবি তুলেছেন। তাই অনেকেই লুপাকে বলেছেন রিজেন্ট গ্রুপের সাহেদের লেডি ভার্সন। 

লুপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকাতেও পরিচিত মুখ। অনেক ডাকসাইটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। সোশ্যাল নেট ওয়ার্কের মাধ্যমে ছবিসহ এসব খবর এখন ভেসে বেড়াচ্ছে। লুপা ফেসবুকেও সক্রিয়। তার ফেসবুক প্রোফাইল (Lupa Talukder) ঘেঁটে দেখা গেছে, পরিচয়ের লম্বা বহর। পরিচয় পর্বে লেখা রয়েছে অগ্নি টিভির ম্যানেজিং ডিরেক্টর, আওয়ামী পেশাজীবী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র রিপোর্টার নবচেতনা, সিনিয়র রিপোর্টার ও সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার মোহনা টিভি, ডিরেক্টর শীর্ষ টিভি, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাপ্তাহিক শীর্ষ সমাচার এবং বাংলাদেশ কবি পরিষদেরও সদস্য তিনি।  
 জানা গেছে, লুপা তালুকদারের নামে হত্যা, অপহরণ, মানব পাচারসহ বেশ কিছু মামলা রয়েছে। তবুও তিনি অবাধে সব জায়গায় বিচরণ করেছেন। 

জিনিয়াকে অপহরণের মামলায় ইতিমধ্যে লুপা তালুকদারকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তাকে দুদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন ডিবি কর্মকর্তারা। অপহরণ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তিনি জিনিয়াকে অপহরণ করেছিলেন টাকার লোভ দেখিয়ে। কোনো পাচারকারী চক্রের সঙ্গে লুপার যোগাযোগ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এরই মধ্যে লুপার বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তার গ্রামবাসী। 

লুপার বাড়ি পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা ইউনিয়নে। লুপা ও তার সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে গলাচিপা থানায় একটি হত্যা মামলাও হয়েছে। যদিও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সেই মামলা থেকে রেহাই পান লুপা ও তার পরিবার।

তবে স্থানীয়রা পরিবারটিকে নারী ও শিশু হত্যাকারী হিসেবেই জানে।

শিশু 'অপহরণকারী' কে এই লোপা তালুকদার?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৩ সালে পটুয়াখালীর গলাচিপা থানায় লুপা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওই হত্যা মামলা হয়। মামলা নং-১ তারিখ (১/৬/০৩), ধারা ৩৬৪/৩০২/২০১/৩৪ দণ্ডবিধি।

মামলার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শাহিনুর নামে এক নারী গৃহকর্মীকে লুপার স্বামী (সাবেক) ধর্ষণ করে। এতে শাহিনুর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়। এর পর লুপা, তার স্বামী শাহিনুর ও তার শিশুকন্যাকে অপহরণ করে ট্রলারে তুলে শ্বাসরোধে হত্যার পর বস্তাবন্দি করে নদীতে ফেলে দেন। এ ঘটনার তদন্তে লুপা, তার বাবা প্রয়াত হাবিবুর রহমান ওরফে নান্না মিয়া তালুকদার, তার দুই ভাই প্রয়াত মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে লিটন তালুকদার, মোস্তাইনুর রহমান ওরফে লিকন তালুকদার, লুপার স্বামী রফিকুল ইসলাম বাদল ওরফে শহীদ বাদল, সুজন, হাকিম আলী, সেরাজ মিয়া, আলী হোসেন, ইছাহাক আলী ওরফে ইছছেক আলীসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

পরে ২০১৩ সালে ওই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি লুপা ও তার স্বজনরা ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ রেহাই পান।

তৎকালীন স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার তদবিরে হত্যা মামলা থেকে মুক্ত হন লুপা।

লুপার বিষয়ে আরও একটি বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন এলাকাবাসী।

তারা জানান, এখন পর্যন্ত লুপা চারটি বিয়ে করেছেন বলে জানেন তারা। তবে অলিখিতভাবে এ সংখ্যা আরও হতে পারে বলেও ধারণা তাদের।

লোপার অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরো একজন!তার পরিচয় জানলে হয়ত অবাক হয়ে  যাবেন -

স্থানীয়রা আরও জানান, নিজেকে সাংবাদিক দাবি করেন লুপা। ‘প্রেস লেখা’ একটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করতেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের সংগঠনের অনেক নেতার সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে। কিন্তু তার পড়ালেখা এসএসসির পর আর এগোয়নি। ‘অগ্নি টিভি’ নামে একটি টিভি চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলে পরিচয় দেন। নিজেকে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট বলে পরিচয় দেন তিনি। এমন সব ভুয়া পরিচয়ে স্থানীয় অনেকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন লুপা। সম্প্রতি পটুয়াখালীর দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে শুনেছেন তারা। ডিবির তদন্তকারী দল এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

ডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাংবাদিক পরিচয়ে লুপা বেগম নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত। মাদকসহ নানা ধরনের প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। এ মুহূর্তে জিনিয়া অপহরণের বিষয়টি নিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাকে।

বুধবার রিমান্ডে লুপার দাবি, জিনিয়াকে তিনি লালন-পালন করে বড় করতে চেয়েছিলেন।

যদিও ডিবি কর্মকর্তাদের কাছে এমন বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেননি লুপা। লুপার কোনো বক্তব্যে বিশ্বাস করতে পারছেন না তদন্তকারী কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে জিনিয়া অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস বলেন, লুপার অতীত রেকর্ড একদমই ভালো নয়। তার বাড়ি পটুয়াখালীতে। সেখানে তিনি এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে খুন করার মামলার আসামি ছিলেন। তার জীবনযাপন নিয়েও বিস্তর অভিযোগ আছে। আমরা ধারণা করছি, শিশু জিনিয়াকে বড় করে তোলার পর তাকে দিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড করার পরিকল্পনা থেকেই অপহরণ করেন লুপা।

জিনিয়াকে লালন-পালনের বিষয়ে লুপার দাবিকে বিশ্বাস না করার বিষয়ে মিশু বিশ্বাস আরও বলেন, জিনিয়াকে যে বাসায় আটকে রাখা হয়েছিল, সেই বাসাটি লুপা তালুকদারের কথিত এক বোনের। জিনিয়াকে নেয়ার সময় তার মায়ের সম্মতি নেননি লুপা। শাহবাগ থানায় এ বিষয়ে অবগত করলেও আমরা তার কথায় বিশ্বাস করতাম। অথচ তিনি অপহরণ করে মেয়েটিকে নিয়ে কথিত বোনোর বাসায় রেখেছিলেন। ঘটনার দিন লুপা তালুকদারের মেয়ে তার সঙ্গে ছিল। তাকে খুঁজছে পুলিশ।

লুপার বিরুদ্ধে রয়েছে জালিয়াতির অভিযোগও।  পড়া লেখার দৌড় এসএসসি হলেও লুপার ফেসবুক প্রোফাইলে উল্লেখ রয়েছে, তিনি অগ্নি টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ আওয়ামী পেশাজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক।
দাবি করতেন যে তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল এবং টিভি চ্যানেলে সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার ছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য বলেও পরিচয় দিতেন। শুধুমাত্র মোহনা টিভির একটি বিজনেস কার্ড দিয়েছেন। তার দাবি, মোহনা টিভিতে তিনি একবার কাজ করেছেন। তার ফেসবুক প্রোফাইলে দেখা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে সাইক্লোন প্রস্তুতি প্রোগ্রাম (সিপিপি) পুরষ্কার ২০১৯ গ্রহণ করছেন। লুপা ফেসবুক পেজে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রীদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করেছেন। আসলে তার ছদ্মবেশের শেষ নেই। 

SHARE THIS ARTICLE