
ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গিরদার, আইরিশ বাংলাপোষ্টঃ বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, গন আন্দোলনের জোয়ারে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করে ভারতে অবস্থান করছেন। তিনি পালিয়ে গিয়েছেন নাকি তিনি আপাতত ভারতে অবস্থান করছেন এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে, আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এমতাবস্থায়, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছ্র কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কোন ব্যাবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানে নেই বলেই আমাদের জ্ঞান। তাই বর্তমান সংবিধান অনুসারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা কিভাবে হয় আমাদের প্রশ্ন থাকলো বিশেষজ্ঞদের নিকট? “তত্ত্বাবধায়ক সরকার” নামে পরিচিত একটি বিধান অতীতে সংবিধানে ছিল। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩ তম সংশোধনী করা হয়েছিলো ১৯৯৬ সালে। ঐ সংশোধন অনুসারে, সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা এবং নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার লক্ষ্যে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।
সংবিধানের ১৩ তম সংশোধনী অনুযায়ী বাংলাদেশে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যাইহোক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলে, ২০১১ সালের ৩০শে জুন আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান পুন:সংশোধনের মাধ্যমে ঐ ধারাটি বাতিল করে দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে আপিল বিভাগের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছিলো যে বিচার বিভাগকে জড়িত না করে এই ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী দুই মেয়াদে নির্বাচন হতে পারে।
যাইহোক, এই পরামর্শ অনুসরণ না করে, আওয়ামী লীগ সরকার মাত্র দেড় মাস পরে,৩০শে জুন, ২০১১ তারিখে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করে দেয়। এমতাবস্থায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন অবৈধ বলে সাধারনভাবে আমরা মনে করি। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী শুধুমাত্র বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তার অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই সরকার তখন বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। সংবিধানে আকস্মিকতার কোন সুযোগ রাখা হয়নি কিংবা পদত্যাগ করা হলে কি হবে সেটা উল্লেখ না থাকায় এখন দেশে এক ধরনের সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকারের আকস্মিক পতন এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি উঠেছে। দাবী উঠতেই পারে, কিন্তু আইনে কিংবা বিধিতে আবেগ কিংবা গনজাগরণের বৈধতার কোন সুযোগ নেই বলেই আমাদের জানা। সংবিধানে এর কোন সমাধান না থাকায় আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে। অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, আইনের বিজ্ঞ ব্যাক্তি হয়ে “বিশেষ সময়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সুতরাং, এই ধরনের একটি বিধান তৈরি করা যেতে পারে, তবে ভবিষ্যতে এর সাংবিধানিক বৈধতা প্রয়োজন হবে।” এই উক্তি করে কিভাবে অবৈধতাকে বৈধ করলেন তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছেনা। বিশেষ করে দেশের উচ্চতম বিচারালয় সুপ্রিম কোর্ট যেখানে এই ব্যাবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যাবস্থাকে বিলুপ্ত করা হয়েছে।
ড: আসিফ নজরুল ১৯৯১ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের একটি অস্থায়ী সরকারের প্রধান হওয়ার উদাহরণও উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, গণঅভ্যুত্থানের ফলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর তিন মাসের মধ্যে পঞ্চম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি অন্তর্বর্তী বা অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিলো তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের অধীনে একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিলো।
বিচারপতি শাহাবুদ্দিনকে প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়, বৈধ পন্থায় তারপর তারপর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের মাধ্যমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পঞ্চম সংসদে ১১ তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটিকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়। কিন্তু ২০২৪ সালে, দেশের অবস্থান ১৯৯১ সাল থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন সত্য কিন্তু সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত্য নেই, বিশেষ কিরে সদ্য ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের কোন অংশগ্রহন এখানে নেই এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যে বিশাল জনসমর্থন আছে সেটা বোধ করি অস্বীকার করার জো নেই।
জনতার কথা বলে, জোরে কোন ব্যাবস্থাকে বৈধতা প্রদান করা হলে, অদুর ভবিষ্যতে এর বৈধতা না থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এমতাবস্থায়, সাংবিধান এবং আইনের ব্যাপারে সম্পুর্ন অজ্ঞ একজন ব্যাক্তি হিসাবে আমি কয়েকটি পন্থা প্রস্তাব করছি।
১। আওয়ামী লীগ সহ সকল দলের ঐক্যমত্য তৈরী করা।
২। সুপ্রিম কোর্ট থেকে বিশেষ ব্যাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতার একটি প্রত্যয়ন গ্রহন।
৩। পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনরায় দায়িত্ত্ব প্রদান করে, একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বৈধ সংসদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
৪। যদিও সংবিধানে রেফারেন্ডামের কোন ব্যাবস্থা রাখা নেই, তবুও গনতন্ত্রের মূল ভিত্তি জনগনের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে সমুন্নত রেখে দ্রুত একটি রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনগনের মতামতের ভিত্তি সৃষ্টি করা এবং সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে বৈধতা তৈরী করে সরকার গঠন করা।