লেখক- রহমান ফাহমিদাঃ হঠাৎ করেই একজন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ফিচার লেখার জন্য অনুরোধ করলেন আমাকে ।যে আমাকে অনুরোধ করলেন ,আমি তখন তাকে বল্লাম,”এমন একজন বাক্তিত্বকে নিয়ে লেখার আস্পর্ধা বা সাহস কোনটাই আমার নেই !”কিন্তু তিনি খুবই নাছোরবান্দা ! সে বলল আমাকে,”ম্যাডাম,আপনি চেষ্টা করলেই পারবেন ।“আমার লেখার প্রতি তার এত কনফিডেন্স দেখে আমার খুব ভাল লাগলো। তাই ভাবলাম !আমার দেখা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, লিখেই ফেলিনা ,দেখা যাক কি হয় ?যেই ভাবা সেই কাজ ।
বঙ্গবন্ধু নামটির সাথে আমার পরিচয় ১৯৭১সাল থেকে কারণ তখন মুক্তিযুদ্ধের সময় ,আমার বয়স ছিল ৪/৫ বছর ।মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হল তার আগের থেকেই বড়দের মুখে বঙ্গবন্ধু নামটি সবসময়ই শুনতে পেতাম ।কিন্তু বুঝতামনা কিছুই !ভাবতাম এ আবার কেমন বন্ধু ?বন্ধুত জানি সবার থাকে ।আমারও তো বন্ধু আছে !যদিও স্কুলে তখনও ভর্তি হইনি কিন্তু বাড়ির আশেপাশের অনেকেই তো বন্ধু ছিল।একদিন কৌতূহলবশে আমার এক গুরুজনকে জিগ্যেস করলাম,”বল্লাম,বন্ধু তো জানি ! কিন্তু বঙ্গবন্ধু মানে কি?”।তখন তিনি বল্লেন,”মহান নেতা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলা হয় কারন তিনি বাংলার সকল মানুষের অতিপ্রিয় বন্ধু । তাই তাকে বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশের সবশ্রেনীর মানুষের বন্ধু বলা হয় ।“রাজনীতি বুঝতামনা ! এমন কি কেন দেশে যুদ্ধ হচ্ছে ?কেন এত মানুষ মারা যাচ্ছে ? কিছুই বুঝতাম না তখন । যুদ্ধের সময় মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি যেতাম আবার ঢাকায় আসতাম ।তখন এক জায়গায় থাকতাম না ,পরে জানলাম আব্বা যেহেতু সরকারি চাকুরি করতেন তাই তাকে বাধ্যতামূলকভাবে অফিস করতে হত ।মাঝে মাঝে বড়রা যখন দেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতেন তখন কিছু কিছু কথা শুনতে পেতাম ।এই যেমন, বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ।হয় তো তাকে মেরে ফেলা হবে ! ইত্যাদি নানা বিষয়ই ।
পরবর্তীতে বড় হয়ে জেনেছি,১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পরে পাকিস্তানী বাহিনী তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় । গ্রেফতারের আগে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী তিনি পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন ।এরপর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার কর্মকাণ্ড চালান ।তিনি প্রথম ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারন অদিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন,বংলাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য।
আমার ঝাপসা ঝাপসা মনে আছে, আমাদের বাসায় একটি কাঠের দরজা লাগানো বাক্সের মধ্যে একটি টিভি ছিল ।সেই দরজা খুলে টিভি দেখতে হতো!যেদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন ,সেদিন আমাদের বাসার সবাই সেই টিভির সামনে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে ছিলেন ।কারণ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য সরাসরি টিভিতে দেখানো হবে ।তখন তো আর এত টিভি চ্যানেল ছিলোনা ,একমাত্র বিটিভিই ছিল ভরসা!টিভিতে দেখলাম,লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষ অধির আগ্রহে ফুলেরমালা হাতে অপেক্ষা করছে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিবার জন্য ।যখন বঙ্গবন্ধুকে বহন করা বিমান এয়ারপোর্টের রানওয়েতে এসে থামলো তখন জনতার উচ্ছ্বাস কে দেখে !অনেকে তো পাগলের মত কাঁদছিল ।বিমানের দরজা যখন খুলে গেল,দেখা গেল এক উচু লম্বা দীর্ঘকায় ব্যক্তিত্বসমপন্ন এক ব্যক্তি বেরিয়ে এসে সবাইকে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।সেই প্রথম আমি টিভির মাধ্যমে সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম ।আমার ছোট্ট মনে তখন প্রশ্ন জাগলও এই ভেবে যে, “এই লোকটিই তাহলে সকলের বঙ্গবন্ধু !”আমারও তাকে দেখে কেন জানি,তার জন্য শ্রদ্ধায় মন ভরে গেল এবং আমার ছোট্ট মনেও তখন সে, বন্ধু হিসেবে জায়গা করে নিল ।সেই সাথে আমিও আমার আশেপাশে অনেককেই কাঁদতে দেখলাম ।তখন অনুভব করিনি সবার চোখে পানি কেন ?তবে এখন অনুভব করি,তার প্রতি সবার ভালোবাসাই সবাইকে কাঁদিয়েছে!তিনি ছিলেন জনদরদী নেতা ও বন্ধু ।তার কাছে সবার সমান মর্যাদা ছিল ।কাউকে তিনি ছোট করে দেখতেন না ।গরীব দুঃখী সবাইকে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরতেন ।বিশালদেহী এই অবিসংবাদীত নেতার মনটাও ছিল আকাশের মত বিশাল ।যে আকাশে সকলেই, হাজার তারার মত জায়গা করে নিতে পারতো ।
বাংলাদেশকে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুপ্ত বাসনা জাগ্রত ছিল তার মনে সর্বদা ।কিন্তু সবচেয়ে কষ্টের বিষয় এই যে, যে দেশের মানুষ এবং যে দেশকে নিয়ে তার এত ভাবনা সেই দেশের মানুষই তার সাথে বিশাসঘাতকতা করেছিল ,যেমন করেছিল বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌল্লাহর সাথে কতিপয় বাঙ্গালী ।যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে জেলখানায় তার কক্ষের পাশে কবর খুঁড়ে রেখেছিল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিবে বলে !কারন সে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের সাথে কোনভাবেই দেশ ও জাতির জন্য কোন আপোষ করেননি ।সেই পাকিস্তানী শএুবাহিনী তাকে মারতে পারলো না কিন্তু যেই দেশ ও মানুষের জন্য তার সারাজীবনের ত্যাগ স্বীকার করা ! সেই দেশের কতিপয় বিপদগামী সামরিক বাহিনী্র সদস্যরা তাকে বাঁচতে দিল না ।১৯৭৫সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হন কতিপয় বিপদগামী সামরিক সদস্যদের হাতে ।সেই নরপশুগন খুব সহজেই সফলভাবে তাকে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে যা কিনা পাকিস্তানি শএুবাহিনী সফল হতে পারেনি ।এইভাবে সমাপ্তি ঘটে পৃথিবীর বুক থেকে একটি উজ্জ্বল নক্ষএের ।সেদিনও আমি মানুষকে কাঁদতে দেখেছি পাগলের মত,এমনকি আমিও খুব কেঁদেছি ।বঙ্গবন্ধুর দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় মানুষ কেঁদেছে খুশীতে আর তাঁর নিহত হবার খবর শুনে কেঁদেছে দুঃখে ও কষ্টে ।
আমাদের প্রানপ্রিয় বঙ্গবন্ধু দৈহিকভাবে পৃথিবীর বুক থেকে চলে গেলেও মানষিকভাবে বেঁচে আছেন এখনো, সবার হৃদয়ের গহীনে ।হাজারও স্যালুট তোমাকে অবিসংবাদিত বীরনেতা প্রাণপ্রিয় “বঙ্গবন্ধু”।
১৬/১১/১৫ইং