
ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার শুক্রবার ঘোষণা করেছে যে, কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে তারা নূতন একটি টেবলেট তৈরি করতে পেরেছে যা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাক্তিদের গুরুতর অসুস্থতা প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী। এটা তারা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণ করতে পেরেছে বলেই দাবী করেছে, ফাইজার বলছে এই ঔষধটি যদি রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে মুখে খাবার জন্য দেওয়া হয় তাহলে হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যুর ঝুঁকি ৮৯% কমিয়ে দেবে। মুখে খাবার এই ঔষধটি “প্যাক্সলোভিড” নামে বাজারজাত করতে যাচ্ছে ফাইজার।

ফাইজার বলেছে যে বিশেষজ্ঞদের একটি স্বাধীন বোর্ড তাদের ক্লিনিকাল ট্রায়ালটি দ্রুত বন্ধ করার কথা বলেছে কেননা ইতিমধ্যে রোগীদের জন্য এই ঔষধের উপকারিতা বিশ্বাসযোগ্য ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ট্যাবলেট ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের কাছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবেদন জমা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে ফাইজার।
নতুন শ্রেণীর সহজ ব্যবহারযোগ্য এই ট্যাবলেটের আবিষ্কার কোভিড চিকিৎসায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে যে সকল দেশ ইতিমধ্যে অধিকাংশ মানুষকে টিকা প্রদান করে ফেলেছে, সেই সব দেশে এই ঔষধ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কমিয়ে আনবে। টিকা দেবার ফলে ইতিমধ্যে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কমে এসেছে এর সাথে যখন এই ট্যাবলেট যুক্ত হবে তখন এই ঔষধ নাটকীয় সাফল্য প্রদর্শন করতে পারে।
ইতিমধ্যে আরেকটি মুখে খাবার ঔষধ, “মার্ক” নামক কোম্পানি বাজারজাত করার কাছাকাছি চলে এসেছে, গতকাল শুক্রবার যুক্তরাজ্য প্রথম দেশ হিসাবে এই ঔষধকে অনুমোদন দিয়েছে। ঔষধটির নাম হচ্ছে “মলনুপিরাভির”। মার্ক কোম্পানি ইতিমধ্যে আমেরিকাতে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুত এই মলনুপিরাভির ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনুমোদন পেয়ে যাবে।

“প্যাক্সলোভিড” এবং “মলনুপিরাভির” নামক এই দুটি ঔষধ ফার্মেসিতে পাওয়া যাবে এবং যারা কোভিড রোগে আক্রান্ত হবেন তারা বাসায় থেকেই এই ঔষধ সেবন করতে পারবেন। অন্য যে সকল ঔষধ ইতিমধ্যে বাজারে এসেছে তার মধ্যে “রেমডিসিভির” এবং আরও কয়েকটি মনোক্লোনাল এন্টিবডি শুধুমাত্র ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন হিসাবে ব্যাবহার করা যায় এবং এটা দেয়ার জন্য হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের প্রয়োজন হয়।
ফাইজারের এই ঔষধের প্রাথমিক সময়ে সরবরাহ সীমিত হবে, তাই কোভিড আক্রান্তদের মধ্যে যাদের উচ্চ ঝুঁকি আছে যেমন যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশী কিংবা যারা অত্যধিক মোটা তাদের জন্য ব্যাবহার করা যেতে পারে। তবে, ফাইজার বলেছে এই বছরের শেষ নাগাদ তারা প্রায় দুই লক্ষ রোগীর ব্যাবহারের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঔষধ বাজারজাত করতে পারবে আর আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তারা ২ কোটির বেশী মানুষের জন্য এই ঔষধ বাজারজাত করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইতিমধ্যে ফাইজারের নিকট থেকে প্রায় ২ লক্ষ কোর্স ঔষধ ক্রয়ের জন্য আলোচনা করছে আর মার্ক কোম্পানির কাছ থেকে সমপরিমাণ ক্রয়ের চুক্তি করে ফেলেছে। এছাড়া তারা আরও বেশী পরিমাণ ঔষধ কেনার ব্যাপারে কোম্পানিগুলোর সাথে আলোচনা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। মলনুপিরাভির ঔষধের প্রতি কোর্সের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মার্ক কোম্পানিকে ৭০০ ডলার করে দিচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এই ঔষধ কেনার ব্যাপারে কোম্পানিগুলোর সাথে আলোচনা চালাচ্ছে। ফাইজার অবশ্য বলেছে যে, তারা গরিব দেশগুলোর জন্য দাম কম রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে।
মার্ক কোম্পানির মলনুপিরাভির ঔষধটি প্রতিদিন ৮টি করে ট্যাবলেট খেতে হবে ৫দিন, অর্থাৎ মোট ৪০টি ট্যাবলেট। আর ফাইজারের প্যাক্সলোভিড খেতে হবে প্রতিদিন ৬টি ট্যাবলেট করে ৫দিনে সর্বমোট ৩০টি।
এখন পর্যন্ত এই ঔষধ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের মধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে ফাইজার কম ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের এবং ভাইরাসে সংক্রমিত একই পরিবারের লোকদের উপরও পরীক্ষা চালাচ্ছে। মঙ্গলবার ঘোষিত পরীক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে মোট ১২০০ জন প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো যারা ফাইজারের ঔষধ কিংবা প্লাসেবো ট্যাবলেট গ্রহণ করেছিলেন। এই পরীক্ষা চালানোর সময় মূলত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ চলছিলো এবং রোগীরা টিকা প্রাপ্ত ছিলেন না এবং তাদের অতিরিক্ত ঝুঁকি ছিল।
ফাইজারের প্যাক্সলোভিড যারা ৩ দিনের মধ্যে গ্রহণ করেছেন তাদের জন্য এই ঔষধ ৮৯% কার্য্যকরি ছিল আর যারা ৪র্থ কিংবা ৫দিন থেকে শুরু করেছেন তাদের বেলা হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যুর সম্ভাবনা ৮৫% কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে মার্ক কোম্পানির মলনুপিরাভিরের কার্য্যকারিতা ছিল ৫০%। মনোক্লোনাল এন্টিবডি দেয়া হলে ঝুকিপূর্ন রোগীদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যুর সম্ভাবনা ৭০% কমায় বলে জানা গেছে। এই ঔষধগুলোর তেমন কোন পার্শ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়নি।
এই ঔষধগুলি বাজারে আসলে কোভীড চিকিৎসায় যুগান্তকারী সাফল্য আসবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে টিকাপ্রাপ্ত দেশগুলোতে ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ আর বেশী অসুস্থ হচ্ছেন না কিংবা মারা যাচ্ছেন না। এর সাথে যখন এই ঔষধ দেয়া হবে তখন হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা কিংবা মৃত্যুর সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় চলে আসতে পারে। তবে এই ঔষধ আগেভাগে শুরু করা আবশ্যক অর্থাৎ সংক্রমণ শুরুর ৩-৫ দিনের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ঔষধগুলো প্রয়োজনীয় পরিমাণে বাজারে আসতে সময় লাগবে আর ঔষধগুলোর দাম কমিয়ে না আনলে সকলের জন্য এই মূল্যে ঔষধ কিনে ব্যাবহার করা কঠিন হবে।
তথ্যসূত্রঃ ফাইজার, মার্ক, নিউ ইয়র্ক টাইমস, আর টি ই, আইরিশ টাইমস