আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ফুটবলের রাজা ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে আর নেই। ৮২ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন । বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) দিনগত রাত ১টায় আন্তার্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ফুটবল ইতিহাসে একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জয় করেন পেলে। ১৯৫৮ সালে যখন ব্রাজিল বিশ্বকাপ জয় করে, তখন পেলের বয়স ছিল কেবল ১৭ বছর। এরপর ১৯৬২ এবং ১৯৭০ সালেও বিশ্বকাপ জয় করেন তিনি। তিনি ২০০০ সালে ফিফার শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।
ইতিহাসে একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন পেলে। তার একুশ বছরের ক্যারিয়ারে ১ হাজার ৩৬৩টি ম্যাচে ১ হাজার ২৮১টি গোল করেছেন। এর মধ্যে ব্রাজিলের হয়ে ৯১ ম্যাচে করেন ৭৭টি গোল।
১৯৭০ সালে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ফিফা গোল্ডেন বল পুরস্কারও জেতেন তিনি। তবে বেশ কয়েকবছর ধরেই শরীর ভালো যাচ্ছিলো না পেলের। ২০১৫ সালে স্নায়ুর সমস্যায় মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচারও করা হয় তার। কিডনি ও প্রস্টেটের সমস্যা নিয়ে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ফুটবলের কিংবদন্তি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মস্কোয় রাশিয়া বিশ্বকাপের এক অনুষ্ঠানে হুইলচেয়ারে বসা অবস্থাতেই দেখা গিয়েছিল তাকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রাজিলের সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতাল ভর্তি হন পেলে। সেখানে তার একটি টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। রুটিন পরীক্ষায় তার টিউমার ধরা পড়ে। চলতি বছর ২০২২ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে তাকে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ফুটবলের বাদশা পেলের জীবনী – Pele Biography in Bengali :
নাম (Name) | এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু বা পেলে (Pele) |
জন্ম (Birthday) | ২৩ অক্টোবর ১৯৪০ (23rd October 1940 |
জন্মস্থান (Birthplace) | ব্রাজিল |
উচ্চতা | ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি |
মাঠে অবস্থান | ফরোওয়ার্ড অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার |
জাতীয় দল | ব্রাজিল |
অর্জন ও সন্মাননা FiFA World Cup | 1958 SwedenNational Team (সোনা)1962 ChileNational Team (সোনা)1970 MexicoNational Team (সোনা) |
Copa América | 1959 ArgentinaNational Team |
পেলের জন্ম – Pele Birthday :
পেলের ছোট্টবেলার গল্পকথা আমরা সংক্ষেপে তা জেনে নিই । পেলের পুরো নাম এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু এবং ডাকনাম পেলে ৷ পেলে (Pele) জন্মেছিলেন ব্রাজিলের ট্রেস – কেরাকোয়েস অঞ্চলে ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর । ছোটো থেকেই খেলতে ভালোবাসতেন । খেলাধুলার প্রতি একটা অদম্য আকর্ষণ ছিল পেলের ।
পেলের পরিবার – Pele’s Family :
বাবা ডন্ডিনহো ছিলেন একজন ফুটবল খেলোয়াড় । ক্লাব স্তরে দারুণ খেলা খেলে গেছেন । একবার ক্লাব ম্যাচ খেলতে গিয়ে দারুণ আঘাত পেলেন । শেষ পর্যন্ত আর মাঠে নামতে পারলেন না । এখন কী করবেন ? অভাবের সংসার । ছেলে ডিকোকে বাবার মতো খেলতে দেখলে মা ভীষণ রেগে যেতেন । কারণ তিনি জানেন এই খেলা থেকেই তাঁর সংসারে এত অন্ধকার । খেলাপাগল মানুষ বলেই তাঁর বাবা ডনডিনহো জীবনে আর কিছু করতে পারেননি । দারিদ্রতাকে বরণ করেছেন ।
কিন্তু ব্রাজিল দেশটার সঙ্গে ফুটবল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে । ব্রাজিলের আকাশে বাতাসে আছে ফুটবল । আছে মানুষের চিন্তা ভাবনায় নিশ্বাস – প্রশ্বাসে , আছে বড়োলোকের উল্লাস এবং গরীবের বেঁচে থাকার লড়াইতে । ব্রাজিলের হাজার হাজার নিরন্ন অসহায় মানুষ ফুটবলের মধ্যে আত্মার মুক্তি খুঁজে পান । কাজেই তিনি কী করে ফুটবলের জগত থেকে ডিকোকে সরিয়ে দেবেন ?
পেলের শৈশবকাল – Pele’s Childhood :
ডিকো ছোটোবেলা থেকেই ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন । নিরন্তর দারিদ্রতার আঘাত ছিল , ছিল অনিশ্চয়তার অন্ধকার । তবুও সারাদিন ফুটবল মাঠে থাকতে ভালোবাসতেন ডিকো । বয়স তখন কত হবে ? তখন ডিকোর বয়স মাত্র তেরো বছর ।
পেলের ক্রীড়া জীবন – Pele Sports Life :
১৯৩০ সাল – ব্রাজিল বিশ্বকাপে দলের অন্যতম ফুটবলার ছিলেন ভাল্দেমার ডি ব্রিটো । এখন তিনি এক নামকরা পেশাদার কোচ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছেন । কোচ হিসাবে ব্রিটোর খ্যাতি তখন আকাশচুম্বী । যেখানে নতুন প্রতিভার সন্ধান পেতেন , সেখানেই ছুটে যেতেন । ছোটোদের খেলা শেখাতে গিয়ে এলেন ডিকোর ক্লাব জুভেনাইল এ । তেরো বছরের কিশোরের ক্রীড়াকুশলতা দেখে অবাক হয়ে গেলেন । এই ছেলেটি নিজে নিজে এত ভালো খেলা শিখল কী করে ? তিনি , বছর খানেকের বেশি তালিম দিলেন ডিকোকে । তারপর ব্রিটো হঠাৎ চলে গেলেন অন্য ক্লাবে । যুক্ত হলেন পেশাদার কোচিং – এর সঙ্গে । বছর খানেক বাদে ফিরে এসে পনেরো বছরের রোগা চেহারার ডিকোকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন । তাঁর ইচ্ছে ডিকো যেন সান্টোস ক্লাবের হয়ে খেলতে নামেন । সান্টোস একটি বিশ্ববিখ্যাত ক্লাব । সেখানে খেললে অনেক বেশি মানুষের সামনে আসার সুযোগ পাওয়া যাবে । সাংবাদিকদের কাছে নিজেকে পরিচিত করানোর সুযোগ পাবে । অভিজ্ঞ কোচ বুঝতে পেরেছিলেন ছোট্ট ডিকোর মধ্যে অগ্নি সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে , তাই ডিকোকে ঠিক জায়গায় আনতে হবে ।
পেলের ছদ্মনাম – Pele Pseudonym Name :
ডিকো কে , তা কি তোমরা বুঝতে পারছ ? আমাদের পেলেই হলেন ওই ডিকো । পেলের আরও অনেকগুলি ছদ্মনাম আছে । যেমন এডসন , কালো মুক্তো , ফুটবল সম্রাট ইত্যাদি । তবে পেলে নামটির মধ্যেই বোধ হয় একটা আশ্চর্য জাদু লুকিয়ে আছে ।
পেলের স্কুল জীবন – Pele School Life :
এই নামের উৎস কী ? পরিণত বয়সে পেলে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন — “ সাত বছর বয়সে পেলে নামের সঙ্গে আমার পরিচয় । আমার জন্মস্থান ট্রেস কোরাকোয়েস থেকে সাত বছর বয়সে বাউরুতে চলে আসি । ওখানকার সমবয়সী ছেলেরা আমাকে ‘ পেলে ’ – ‘ পেলে ’ বলে খেপাত । এই শব্দটার মানে কী , আমি জানতাম না । অনেকে বলে থাকেন , আমি বহিরাগত , শহুরে চালচলনের সঙ্গে নিজেকে ঠিকমতো রপ্ত করতে পারিনি । তাই বোধহয় ওরা আমাকে গেঁইয়া ভূত বলে রাগাবার চেষ্টা করত । এই নিয়ে প্রায়ই ওদের সঙ্গে মারামারি হত । একদিন স্কুলের সব মেয়েরাও হাসাহাসি করে আমাকে ‘ পেলে ’ নামে ডাকতে শুরু করল । মেয়েদের সঙ্গে হাতাহাতি হয়ে গেল । ঘটনাটার জের অনেক দুর গড়িয়ে গিয়েছিল । দু’দিন স্কুল থেকে আমাকে সাসপেন্ড করা হল । বাবাকে ডেকে পাঠানো হল ওই স্কুলে । তারপর অবশ্য সবাই ঘটনাটা ভুলে গেছে । আমিও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি নতুন স্কুলের সঙ্গে । কিন্তু কী আশ্চর্য , ওই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দেওয়া বিদ্রপের নামটাই আমার সাথে রয়ে গেল । আমার যে অন্য একটা নাম আছে , সেটা সবাই ভুলে গেল ৷ এই নামেই আমি খ্যাতি , প্রতিষ্ঠা , যশ , অর্থ – সবকিছু – পেয়েছি । ”
পেলে নামের অর্থ – Meaning of Pele :
আবার কেউ কেউ বলে থাকেন — না , ‘ পেলে ’ শব্দটির মধ্যে একটা আলাদা অর্থ লুকিয়ে আছে । ছোট্টবেলায় ফুটবল মাঠে পেলে যখন – তখন হাত দিয়ে কান ধরে ফেলতেন । তাই সমবয়সী বন্ধুরা তাকে ‘ পে – লে ’ বলে খেপাত । পোর্তুগিজ ভাষায় ‘ পে ’ কথাটার মানে হল ‘ পা ’ , আর তুর্কি ভাষায় ‘ লে ’ কথাটির মানে হল ‘ মুখ ‘ । অর্থাৎ তারা পেলেকে এক মহামুর্খ খেলোয়াড় বলেই ভাবতেন ।
পেলের রেকর্ড – Pele Records :
প্রথম শ্রেণীর ফুটবলে ১৩৬৩ টি ম্যাচে ১২৮১ টি গোল করার অসাধারণ রেকর্ড করেছেন পেলে । ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই মাত্র সতেরো বছর বয়সে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলতে নেমেছিলেন পেলে । আমরা সবাই জানি , আমাদের যেমন মোহনবাগান , ইস্টবেঙ্গল , তেমনই লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল । এই দুটি দেশ ফুটবলে মহাশক্তিধর । কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না । তাই আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে পেলে খানিকটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন । সেই খেলাতে তিনি হয়তো ব্যক্তিগত প্রতিভার স্ফুরণ দেখাতে পারেননি , কিন্তু তার আবির্ভাব যে অনেক ডিফেন্ডারের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে , এমন একটা সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল তার খেলার মধ্যে ।