বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরের শেষার্ধে কিংবা আগামী বছরের প্রথম দিকে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত এ মেগা প্রকল্প। তবে টানেলের টোলহার নির্ধারণ নিয়ে জটিলতায় পড়েছে সেতু বিভাগ। মূলত কর্ণফুলী পারাপারে বিদ্যমান শাহ আমানত সেতুতে যানবাহনের টোলহার তুলনামূলক অনেক কম হওয়ায় এ দ্বিধা। আবার নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র টানেল হওয়ায় কাছাকাছি কোনো উদাহরণও মিলছে না। তাই উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টানেলের টোলহার পর্যালোচনার পাশাপাশি প্রতিযোগী সেতুর টোল বিবেচনায় নিতে হচ্ছে সংস্থাটিকে।

সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, টানেলের টোল নির্ধারণে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেতু কর্তৃপক্ষের আওতাধীন সেতু, উড়ালসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে টোলহার নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়াই ওই কমিটির দায়িত্ব। বিলম্ব দেখে গত ১২ মে সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের (সেতু বিভাগ) উপসচিব মো. আবুল হাসান দ্রুত সময়ের মধ্যে টোলহার নির্ধারণের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু বৈঠকের পরও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি কমিটি। বর্তমানে শাহ আমানত সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপারে খুবই নগণ্য পরিমাণ টোল পরিশোধ করতে হয়। ২০১০ সালে চালু হওয়া সেতুটির নির্মাণ ব্যয় কম হওয়ায় টোলের হারও কম। কিন্তু বিদেশী ঋণ নিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তাই টোলহারও সেভাবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে। আবার বিকল্প পথ থাকায় শুরু থেকেই যানবাহনের প্রবাহ ধরে রাখার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষকে।

শুক্রবার খুলে দেওয়া হবে বঙ্গবন্ধু টানেলের দ্বিতীয় চ্যানেল

সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, সর্বশেষ ২৮ জুলাই টোল নির্ধারণ কমিটি বৈঠক করে টানেলের পাশাপাশি শাহ আমানত সেতুর টোলহার দেখে দ্বিধায় পড়ে যায়। সমীক্ষা অনুুযায়ী টানেল দিয়ে প্রাক্কলিত যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে হলে টোলের পরিমাণ কোনোভাবেই বাড়তি রাখা যাবে না বলে মতামত দেন কমিটির সদস্যরা। শাহ আমানত সেতুর চেয়ে সর্বোচ্চ দ্বিগুণ টোল নির্ধারণে তারা ঐকমত্যে পৌঁছেন। আগামী বৈঠকের পর এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির আশা করছেন বলে জানান দায়িত্বশীলরা।

শাহ আমানত সেতুতে টোলের হার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একটি বাসের টোল মাত্র ১৫৫ টাকা। তাছাড়া মিনিবাসের (৩১ সিটের কম) টোল ৫০ টাকা। কিন্তু টানেলের নির্মাণব্যয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ টোল নির্ধারণ করতে হলে বাস কিংবা মিনিবাসের ভাড়া হওয়ার কথা তার কয়েক গুণ বেশি। আবার সেটি করলে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। শাহ আমানত সেতুতে একটি ট্রেলারের টোল (১০ চাকার পরিবহন) ৭৫০ টাকা, বড় ট্রাক (সাড়ে সাত হাজার কেজির বেশি) ৩০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৩ হাজার ৫০১ থেকে সাড়ে সাত হাজার কেজি) ২০০ টাকা, মিনি ট্রাক (সাড়ে তিন হাজার কেজি পর্যন্ত) ১৩০ টাকা, বড় বাস (৩১ আসনের বেশি) ১৫৫ টাকা, মিনিবাস (৩১ সিট) ৫০ টাকা। এছাড়া কৃষিকাজে ব্যবহূত গাড়ি ১৩৫ টাকা, মাইক্রোবাস কিংবা ফোর হুইলার ১০০ টাকা, প্রাইভেটকার ৭৫ টাকা, সিএনজি অটোরিকশা ৩০ টাকা। মোটারবাইকে ১০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হলেও সেটি এখন আর নেয়া হয় না। অন্যদিকে সদ্য উদ্বোধন হওয়া দেশের আলোচিত পদ্মা সেতু দিয়ে একটি বাস চলাচলে টোল দিতে হয় সর্বনিম্ন ১ হাজার ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪০০ টাকা। এছাড়া ট্রেলার (চার এক্সেলের অধিক) ৬ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেল দেড় হাজার টাকা, ট্রেলার (চার এক্সেল পর্যন্ত) ৬ হাজার, ট্রাক (তিন এক্সেল পর্যন্ত) সাড়ে ৫ হাজার, মাঝারি ট্রাক (৮-১১ টন) ২ হাজার ৮০০, মাঝারি ট্রাক (পাঁচ-আট টন) ২ হাজার ১০০, ছোট ট্রাক (পাঁচ টন) ১ হাজার ৬০০, মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০, পিকআপ ১ হাজার ২০০, কার বা জিপ ৭৫০ ও মোটরবাইক ১০০ টাকা।

বঙ্গবন্ধু টানেলের ৮৬ শতাংশ কাজ সম্পন্ন

সংশ্লিষ্টরা বলছে, বঙ্গবন্ধু টানেল পতেঙ্গা এলাকায় হওয়ায় সারা দেশ থেকে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করা যানবাহনগুলোর জন্য সময়সাপেক্ষ হয়ে যাবে। তাছাড়া কক্সবাজারমুখী যানবাহনগুলোর অধিকাংশই পর্যটকবাহী হওয়ায় ভোর কিংবা মাঝরাতে শহর দিয়েই যায়। ওই সময় যানজট না থাকায় চট্টগ্রাম সিটি গেট থেকে অন্তত ১৫-১৮ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে বাড়তি টোলের টানেল ব্যবহার না করার সম্ভাবনাই দেখছে সেতু বিভাগ। ফলে বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ সত্ত্বেও শাহ আমানত সেতুর সঙ্গে সংগতি রেখে টানেলের টোলহার নির্ধারণ ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। যদিও টানেলের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সুপারিশ ‘সি’-তে বলা হয়েছে, চালু হওয়ার পর টানেল দিয়ে ২০২৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এছাড়া ২০৩০ সালে প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬ এবং ২০৬৭ সালে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার গাড়ি চলাচলের। কিন্তু প্রশস্ত ও সুবিধাজনক স্থানে কম টোলে কর্ণফুলী পার হওয়ার সেতু থাকায় টানেলের ব্যবহার নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে সেতু বিভাগ।

সেতু বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বণিক বার্তাকে বলেন, ঋণের টাকা শোধ করতে চাপ তৈরি হলেও কোনোভাবেই টানেল পারাপারের খরচ শাহ আমানত সেতুর টোলের দ্বিগুণের বেশি করা উচিত হবে না। চট্টগ্রাম শহর থেকে অনেক দূরের একটি রুট দিয়ে টানেল নির্মাণ হওয়ায় যানবাহন চালকরা এ সেতুকেই বেছে নেয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাছাড়া বাংলাদেশ এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশে এ ধরনের কোনো প্রকল্প না থাকায় টানেলের টোল নির্ধারণ কঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শ কিংবা নির্দেশনা ছাড়া এটি চূড়ান্ত করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন তিনি। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সেতু বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) মো. রশিদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি কাজ করছে। তারাই টোল নির্ধারণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী ও পরিচালক (কারিগরি) কাজী মো. ফেরদাউস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু টানেল আমাদের জন্য অন্যতম বড় একটি প্রকল্প। এর টোল যুগোপযোগী করে নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি কাজ করছে। তবে মুখ্য সচিব মহোদয় চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলের টিউব খুলে দেয়ার কথা বলেছেন। তাই কমিটিকে দ্রুতই টোল নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে তাগাদা দেয়া হয়েছে।’ টানেলের টোল নির্ধারণে চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতুর টোলহারও পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল নির্ধারণ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টানেলটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যাতায়াতের জন্য আশীর্বাদ। নগরীর ভেতর যানজট কমাতে ওই পথে কক্সবাজার থেকে ঢাকা কিংবা অন্যান্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগে দূরত্ব ও সময় দুটোই বাঁচবে। তবে এ টানেলের টোল নির্ধারণ কোনোভাবেই পদ্মা সেতুর আদলে করা যাবে না। কেননা ঢাকা থেকে দক্ষিণবঙ্গের দিকে যাতায়াতে পদ্মা সেতুর কোনো বিকল্প না থাকলেও ঢাকা-কক্সবাজারে যাতায়াতে টানেলের বিকল্প শাহ আমানত সেতু আছে। তাই বিকল্প সেতুর টোলকে নিরীক্ষণ করেই টানেলের টোল নির্ধারণ করতে হবে। অতিরিক্ত টোল নির্ধারণ করলে টানেলের সুফল পাওয়া যাবে না। মানুষ তখন টাকার কথা চিন্তা করবে।’

SHARE THIS ARTICLE