আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ক্রসফায়ার না বলে বরং বলা উচিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুলি করে হত্যা। কিন্তু আমরা তো বটেই, মিডিয়াও তা বলতে পারছে না। কারণ এই ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। ফলে প্রশাসনের প্রেস রিলিজ- এ বর্ণিত সেই একই গল্প তৈরি হয়। সেই গল্প আওড়ানোর সময় মনে প্রশ্ন জাগে- বোকা কারা? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নাকি জনগন?
এক যুগের বেশি সময় পার হলেও ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে রিটের চূড়ান্ত শুনানি সম্ভব হয়নি।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবারই প্রশ্ন তুলছে। আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থামছেই না। কখনো কথিত ক্রসফায়ার, কখনো বন্দুকযুদ্ধ কখনোবা এনকাউন্টার নামে এ ধরনের হত্যাকা- সংঘটিত হচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কোনো তদন্ত আলোর মুখ দেখে না। বিচারও হয় না।
মানবাধিকার সংগঠনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এক যুগেরও বেশি সময় আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে রুল জারি করেন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও রুল জারি করে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন। কিন্তু সরকারপক্ষ থেকে এসব রুলের জবাব দেওয়া হয়নি। শুনানিও হয়নি দীর্ঘদিনেও। ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন জড়িতরা। গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনার ফের আলোচনায় উঠে এসেছে কথিত ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি। বিভিন্ন
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন থেকে একই দাবি এসেছে। এছাড়া প্রথমবারের মতো রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) পক্ষ থেকেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি উঠেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, শুধু মেজর সিনহা নন, দেশের সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার নির্ধারিত হবে জনদাবি আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে। রিট মামলা যেগুলো হয়েছে, সেগুলোয় ফল আসবে তখনই যখন এর পেছনে আইনি যুক্তি ছাড়াও জনদাবি এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হবে। আর এটা যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।’ তিনি বলেন,
দেরিতে হলেও মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এসব ক্রসফায়ারের নামে খুনের বিচারের জোর দাবি উঠেছে। আমরা এই কথিত বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার নিয়ে বিগত দেড় দশক ধরে কথা বলছি। বন্ধের দাবি করে আসছি। কিন্তু আমাদের দাবিতে সরকার কর্ণপাত করেনি। মন্দের ভালো হলো, এখন এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। অন্যথায় দেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সালে প্রথম ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে। এরপর ২০০২ সালে এ ধরনের হত্যাকা- শুরু হয়। আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে। দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা সব সময়ই এ ব্যাপারে অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে।
এ অবস্থায় ২০০৬ সালের আগস্টে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে একটি রিট করে। এই রিটের প্রাথমিক শুনানি করে ওই বছরের ৬ আগস্ট হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন।
রুলে নিরাপত্তা হেফাজতে আটক ব্যক্তিদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না-এ মর্মে কারণ দর্শাতে বলা হয়। এই রিটের রুল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
লালবাগের জনৈক টুন্ডা ইসমাইলের পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু হয়। এ ঘটনার কেন যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানাতে আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি রুল জারি করেছিলেন। বিষয়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এরপর ২০০৯ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও অবৈধ ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং কর্মজীবী নারী জনস্বার্থে ২০০৯ সালের ২১ জুন হাইকোর্টে রিট করেন। রিটটির প্রাথমিক শুনানি গ্রহণের পর ২৯ জুন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। ‘ক্রসফায়ারের’ নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে নাÑ এ মর্মে কারণ দর্শাতে বলা হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র্যাবের মহাপরিচালক ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। কিন্তু সেই রুলেরও জবাব দেয়নি সরকার।
এরপর ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর মাদারীপুরে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ভাই-লুৎফর খালাসী (৪৫) ও খায়রুল খালাসী (৩০) নিহত হন। ‘সংবাদমাধ্যমে এ খবর জেনে’ বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান ও বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ পরদিন সুয়োমোটো রুল জারি করেন। আদালত রুল জারি করে আর যেন ক্রসফায়ার না ঘটে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কাছ থেকে অঙ্গীকারও নিয়েছিলেন। এরপর সরকারপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছরের ১৪ ডিসেম্বর অবকাশ শেষে আদালত খোলার এক সপ্তাহ পর ওই রুলের শুনানির দিন ধার্য করা হয়। এরপর আর শুনানি হয়নি।
এসব রুলের কেন শুনানি হয় না জানতে চাইলে এইচআরপিবি’র প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, রুল শুনানির জন্য কয়েকটি বেঞ্চে গিয়েছি। কয়েকবার আদালতের কার্যত তালিকায়ও এসেছে। কিন্তু দেখা গেছে রুল শুনানি শুরু হওয়ার আগেই বেঞ্চ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আবার অনেক সময় সরকার
পক্ষ সময় চেয়ে বসে। অনেক বেঞ্চ এ ধরনের রিটের শুনানিই করতে নিতে চান না। তিনি বলেন, আমি মনে করি এসব রিট আবেদনের সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের বিষয় জড়িত। রিট আবেদনগুলোর চূড়ান্ত শুনানি হওয়া প্রয়োজন। অবকাশের পরে আমার রিট আবেদনটি শুনানির জন্য আদালতের নজরে আনব।
এ দিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সালের জানুয়ারি থেকে গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১৯৬টি। ২০১৯ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে ৩৮৮টি, ২০১৮ সালে ৪৬৬টি, ২০১৭ সালে ১৬২ জন মানুষকে বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ কাস্টডিতে থাকা অবস্থায়ও অনেকের মৃত্যু হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ২০১৬ সালে ছিল ১৯৫টি, ২০১৫ সালে ১৯২টি, ২০১৪ সালে ১৫৮টি এবং ২০১৩ সালে ২০৮টি। এসব হত্যাকা- নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। তারপরও এ ধরনের হত্যাকাণ্ড থামছেই না।
দেশে মাদকের ভয়াবহতা ঠেকাতে ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই অভিযানে শুধু কক্সবাজার জেলাতেই পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ২৮০ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা ৯৩ জন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬৯ জন, বিজিবির সঙ্গে ৬০ জন ও র্যাবের সঙ্গে ৫১ জন। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার বন্ধে দুই দফায় ১২৩ জন ইয়াবা কারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এতকিছুর পরও ওই সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা চোরাচালান থেমে নেই।
অন্যদিকে ইয়াবা নির্মূলের নামে কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে গত প্রায় ২ বছরে যেসব নিহতের ঘটনা ঘটেছে তা নিয়েও এখন নানা প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। কথিত
ক্রসফায়ার নিয়ে টেকনাফ পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে লাগামহীন বাণিজ্যের বিষয়টিও এখন সামনে এসেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, কক্সবাজারে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা ‘ক্রসফায়ার’ সংস্কৃতির অবারিত বিকাশের উদাহরণ মাত্র। বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে জবাবদিহি নিশ্চিতের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানায় সংস্থাটি।
সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারাদেশে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সঙ্গে শতাধিক ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮৭ জন। অথচ দেশের সংবিধান সব নাগরিকের আইনি সুরক্ষা পাওয়ার যে অধিকার দিয়েছে, তাতে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকলেই কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করার কোনো অধিকার দেওয়া হয়নি। নিহতদের বেশ কয়েকজন কোনোভাবেই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, এমন তথ্য-প্রমাণ নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি চাঁদা দেওয়া না হলে ‘ক্রসফায়ারে দেওয়ার’ মতো অভিযোগও খুব কম নয়। এই বর্বরতার দায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানই এড়াতে পারে না। দেশে ইয়াবা ব্যবসার লাগাম টানা যায়নি। ‘বড় বড় ক্রীড়নকরা’ এক রকম ‘প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা’ নিয়ে বহাল তবিয়তে আছে। পুলিশ বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত এলিট ফোর্স র্যাব, বিজিবি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু ‘মাদক ব্যবসায়ী’ ও বেশকিছু ‘নিরপরাধ’ মানুষকে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে হত্যা করেছে। এসব ঘটনায় কোনো গ্রহণযোগ্য তদন্ত ও আইনগত পদক্ষেপ না নেওয়ায় এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, কার্যত দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বিনা বিচারে হত্যার লাইসেন্স বা দায়মুক্তি পেয়ে গেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আশা করে সরকার এই ঘটনার সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিনা বিচারে হত্যার সংবিধানবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার কার্যকর উদ্যোগ নেবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ নিজেদের মর্যাদা ও জনআস্থা সমুন্নত রাখার স্বার্থে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।