আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ কোভিড -১৯ মহামারীর মত এক মারাত্মক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সংসদে অর্থমন্ত্রী জনাব আ হ ম মোস্তফা কামাল কর্তৃক উপস্থাপিত ২০২০-২১ সালের ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট কন্ঠভোটে গত মঙ্গলবার পাশ হয়েছে। এই বাজেট ১লা জুলাই ২০২০থেকে কার্য্যকর হলো। এমন একটি সময়ে এই বাজেট গৃহীত হলো, যখন দুর্ভাগ্যক্রমে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। কোভিড-১৯ সনাক্ত করার জন্য পরীক্ষা করার ব্যাবস্থা অপর্য্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও আজ, চীন, কম্বোডিয়া, কাতার এবং কানাডাকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ শনাক্তের সংখ্যায় ১৮ তম অবস্থান নিয়েছে। হাসপাতালে সাধারণ কিংবা আই সি ইউ বেডের স্বল্পতায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে চিকিতসাবিহীন অবস্থায় পথে, প্রান্তরে জীবনের ইতি ঘটছে যা আমরা পত্র পত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি। অক্সিজেন সংকট অবিশ্বাস্য আকারে দেখা দিয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী সংকট থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতি বছরের এক চতুর্থাংশেরও বেশি সময় ধরে লড়াই করে চলেছে। বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে ৮.৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। বিনিয়োগ /জিডিপি অনুপাত ২০১৮-১৯ সালের ৩১.৫৭ থেকে কমে ২০১৯-২০২০ সালে ২০.৮ এসে দাঁড়িয়েছে। শিল্প ও পরিষেবা খাত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি চালক, অস্বস্তিকর অবস্থানে পতিত হয়েছে। সম্ভবতঃ এই দুটি খাতের অসাধারণ সংকোচনের কারণে মধ্য মেয়াদী Macroeconomic Policy Statement (MTMPS) ২০২০-২১ সাল থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫.২% ধরা হয়েছে। ২০২০-২১ সনের বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ৮.২ শতাংশ ধরা হয়েছে (যখন বাজেট বাস্তবায়িত হবে) যদিও চারপাশের দুর্দান্ত অনিশ্চয়তার কারণে এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা আদৌ আছে বলে মনে করাটা বাতুলতা মাত্র। এমটিএমপিএস নথিতে আলোচিত হিসাবে প্রস্তাবিত বাজেটটি অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) Sustainable Development Goals (SDGs) এবং ভিশন ২০৪১ এর লক্ষ্য মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে। সরকার কোভিড-১৯ মহামারী কালীন সময়েও মধ্য মেয়াদী বাজেট, সামষ্টিক ও রাজস্ব কাঠামোর বাইরে যেতে পারেনি। এতে বোঝা যায় যে প্রস্তাবিত বাজেটে বড় ধরনের পরিবর্তন ও নতুনত্ব আনা হয় নাই কারণ অর্থনীতির বিপর্যয় ও ব্যাপক মন্দা থেকে দেশকে রক্ষার জন্য বাজেট গঠনের পর্য্যাপ্ত স্বাধীনতা ছিল না। শংকাবহুল ও উদ্বেগাকুল স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাকে সঠিকভাবে সহায়তার উদ্যোগ এই বাজেটে মোটেও প্রদর্শিত হয়নি। সরকারকে মেগা অবকাঠামো এবং জ্বালানি প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দ অব্যাহত রাখতে হয়েছে অন্যথায় প্রকল্প ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাবে। কোভিড -১৯ শেষ হয়ে গেলে এই প্রকল্পগুলোতে দ্বিগুণ অঙ্কের বাজেট বৃদ্ধির সম্ভাবনাও দেখা দিতে পারে। এটা সহজেই বোঝা যায়, সরকারের এবারের বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাম্প্রতিক দিনগুলিতে কোভিড সংক্রমণের বিস্তার এবং প্রাণহানির দু:খজনক পরিণতি ঘটিয়ে জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। ভেবে দেখুন জাতি হিসেবে আমরা কোনভাবেই হার্ড ইমিউইনিটির পথ বেছে নিতে পারি না, মেনেও নিতে পারিনা। বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবকাঠামোতে, জনবল এবং সহায়তা পরিষেবা এই মুহূর্তে প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদানের জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। এ জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন অবকাঠামো, ঔষধ, সরঞ্জাম, পরীক্ষার সুবিধা, নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট, অ্যাম্বুলেন্স এবং সহায়তা পরিষেবাগুলি বৃদ্ধি করার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দের প্রয়োজন। যদিও স্বাস্থ্য খাতের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও এ ডি বির অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প এবং ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তবে যে হারে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে আর সংক্রমণের হার যেরকম আকাশ ছোঁয়া গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এই বাজেটে প্রদত্ত বরাদ্ধ কোনভাবেই এই সংকট উত্তরণের জন্য পর্য্যাপ্ত হবে বলে আমরা ভাবতে পারছিনা। প্রস্তাবিত বাজেটে যে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলে মনে হচ্ছে এবং যদি কোভিড-১৯ নামক জাতীয় সমস্যাটি শীঘ্রই শেষ না হয় আর সেটা যে শীঘ্রই শেষ হচ্ছে না তা আমরা সকলেই অনুধাবন করতে পারছি, তাহলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকবে। বিপরীতে, সরকার প্রায় ৬ শতাংশ বাজেট ঘাটতি স্থাপনের ‘বড় ঝুঁকি’ বেছে নিয়েছে, যা বেশিরভাগ দেশীয় ব্যাংক ও বিদেশী উত্স থেকে ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে বলেই প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাংকগুলি ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে চাপের মধ্যে আছে তার উপর ঘাটতি পুরনে এগিয়ে আসতে হলে দেশীয় আর্থিক খাতে চাপ অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। তবে, সংকট চলতে থাকলে মন্দা এড়াতে সরকারকে সঙ্কটের সময় বাজেট ঘাটতি বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সরকারী অর্থ ও বাজেট পরিচালন আইন ২০০৯ প্রকাশ করে যে ঘাটতি-জিডিপি অনুপাতকে ‘সহনীয় সীমায়’ রাখা যেতে পারে তবে এই আইনে জাতীয় কোনও সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। সুতরাং, যদিও এটি আর্থিক ও অনার্থিক উভয় খাতেই চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বাজেটটি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে। একই সাথে, সরকারকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা তৈরি করতে হবে, বেসরকারী বিনিয়োগকে উত্সাহিত করতে হবে, নগদ অর্থপ্রদানের প্রয়োজন এবং প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের বিশেষত দুস্থ, দরিদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলিকে সামাজিক সুরক্ষা নেট প্রোগ্রামের (এসএসএনপি) আওতায় আনতে হবে এবং বর্ণিত কোভিড বোঝা বেকারত্ব হ্রাস করতে হবে। এটি বহুলভাবে অনুভূত হয় যে একটি বড় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা আসন্ন, সুতরাং বাজেট অবশ্যই দেশীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাড়াতে প্রস্তুত থাকতে হবে। একই সময়ে, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং দ্বিপক্ষীয় দাতাগুলি প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্থায়ন করতে সক্ষম হবে না কারণ প্রায় সব দেশেরই আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজন দেখা দেবে। সেক্ষেত্রে সরকারের উচিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর বেশি চাপ না বাড়িয়ে বিকল্প ঘাটতি অর্থায়ন ব্যবস্থা প্রস্তুত করা। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা নেট প্রোগ্রাম (এসএসএনপি) গুলিতে প্রস্তাবিত বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ১৭ শতাংশ, যা নতুন প্রকল্পের কারণে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এই বরাদ্ধ বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের ও কোভিড আক্রান্ত পরিবারের উপকারের লক্ষ্যে চিহ্নিত হয়েছে। এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হ’ল মধ্য প্রাচ্য, ইউরোপ এবং উন্নত বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে অভিবাসী শ্রমিকদের চাকরি হ্রাসের পাশাপাশি পণ্য ও পরিষেবার বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের ফলে কিভাবে দেশী-বিদেশী কর্মসংস্থানের সম্ভাব্য বড় ধাক্কা মোকাবেলা করা যায়। অন্তর্বর্তীকালীন কর্মসংস্থানের কৌশলটি প্রয়োজনীয়, কারণ যেহেতু তৈরি পোশাক খাত ইতিমধ্যে বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা করেছে এবং কয়েক মাস ধরে ছোট-মাঝারি অনেকগুলি ব্যবসায় মূলধন হারিয়েছে। বিদেশী কর্মীরা যদি বিশাল পরিমাণে ফিরে আসে তবে বৈদেশিক রেমিট্যান্সও মারাত্মক হ্রাস পাবে। অতএব, সামাজিক সুরক্ষা নেটের আওতাধীন কল্যাণ প্রকল্পগুলির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন প্রয়োজন। অবশেষে, পাশকৃত বাজেটে কোভিড -১৯ দ্বারা প্রকাশিত সুযোগগুলি আঁকড়ে ধরার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক হুমকী ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশল অবলম্বন করা হয়নি। চিকিৎসা বীমা দ্বারা সমর্থিত সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা গ্রহনের সুযোগ গ্রহণ আজ অপরিহার্য্য ছিল। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে একটি ইতিবাচক মূলধন হিসাবে ব্যাবহার করা হলে ভবিষ্যত মহামারীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করা সম্ভব হতে পারত। আমরা মনে করি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে সার্বজনীন চিকিৎসা প্রদানে সক্ষমতা অর্জন করতে চিকিৎসা বীমা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল আগামী বছরে বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, যে সকল দেশ বর্তমানে কোভিড -১৯ এর কারণে চীন থেকে বিনিয়োগ বাইরে নিতে আগ্রহী তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা আগামী দিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’ নামক এই বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের জন্য একটি স্বপ্নদর্শী বাজেট। আভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক মহামারী এবং সেই সাথে অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করে কিভাবে ৮.৫% প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে সেটা দেখার জন্য আমাদেরকে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই মুহূর্তে করোনা মহামারী মোকাবেলা করে টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এরপর দেখা যাবে অর্থনৈতিক উন্নতি “ভি (V)“ নাকি “ইউ (U)“ নাকি “এল (L)“ এর মত হবে।।