বার্লিনে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের ঢল

আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্ক সংকটের পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ইউক্রেনীয় আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন বার্লিনকে৷ শরণার্থীদের সহায়তায় অনেক স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন৷ একাধিক মানবাধিকার সংগঠন পাশে থাকতে এগিয়ে এসেছেন৷ কিন্তু তবুও কাজটা বেশ কঠিন৷

সোমবার রাত একটা নাগাদ বার্লিন স্টেশনের চেহারাটা ঠিক কেমন?
বার্লিন মেন স্টেশনের উল্টোদিকে বিশাল সাদা তাঁবুটা তখন ভর্তি৷ একাধিক মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে৷ কাঠের বেঞ্চগুলো জুড়েও মানুষের ঢল৷ তাঁবুর একটা অংশে শিশুদের জন্য খেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ কোনও কোনও ইউক্রেনীয় শরণার্থীর হাতে বড়সড় সুটকেস, আবার কারও হাতে শুধু একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বা হয়তো সামান্য জামাকাপড়৷ বেঞ্চে বসেছিলেন বছর চল্লিশের ঝানা এন৷ নিরাপত্তার খাতিরে নিজের নাম সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারেননি তিনি৷

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশের জন্য এটা এখটা দুঃসহ পরিস্থিতি৷ কত সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে৷ এটা যে প্রকৃতপক্ষে একটা যুদ্ধ, সেটা আমরা আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি৷ কতদিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি চলবে, আমরা কেউ জানিনা৷’’

চোখেমুখে ক্লান্তি ও হতাশার ছাপ ঝানার৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ঘুমাননি দীর্ঘ সময়৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন ঝানা৷ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে লাভিভে পৌঁছান ঝানা, সঙ্গে ছিল তার মেয়ে৷ এরপর পোল্যান্ড পেরিয়ে বার্লিনে পৌঁছান তিনি৷ তার মা, তার প্রাক্তন স্বামী, তার ভাই অন্য আত্মীয়রা এখনও ইউক্রেনে৷ আতঙ্কে রয়েছেন এই নারী৷ প্রার্থনা করছেন এই পরিস্থিতিতে সবাই যেন বেঁচে থাকেন৷ তিনি নিজে এখন শরণার্থী৷ আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যেন দ্রুত দেখা হয় এমনটা আশা করছেন তিনি৷ তার বোনও দেশ ছেড়েছেন তবে ইউরোপের অন্য কোথাও রয়েছেন তিনি৷

প্রতিদিন এমনই হাজারো ইউক্রেনীয় এসে পৌঁছাচ্ছেন বার্লিনে৷ ১৫ হাজারের কাছাকাছি ইউক্রেনীয় প্রতিদিন আসছেন বার্লিনে৷ পোল্যান্ড হয়ে যারাই আসছেন, তারা প্রথমে জার্মানিতে আশ্রয় খুঁজছেন৷ বার্লিন জার্মানির রাজধানী, তাই ট্রেন স্টেশন কিংবা বাস স্টেশনেও মারাত্মক ভিড় চোখে পড়ছে রোজ৷

বার্লিনের মেয়র ফ্রাঞ্জিজকা গিফে বলেন, “যতটা সম্ভব শরণার্থীদের পাশে থাকছে কর্তৃপক্ষ৷ কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সীমাও রয়েছে৷ ট্রেড ফেয়ারের হলে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে৷”

জার্মান সরকার এবং সেনাবাহিনীর সাহায্য চেয়েছেন তারা৷ জার্মানির অনেক স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে এসেছেন এই বিষয়ে৷ বেসরকারি একাধিক সংস্থা এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে৷ বার্লিন স্টেশনেও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন যারা হয়তো কোনও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত৷ কমলা বা হলুদ ভেস্ট দেখেই চেনা যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবীদের৷ পোশাক এবং খাবার–এই দুটি প্রাথমিক চাহিদার জোগান দেয়ার চেষ্টা করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা৷ এটা সত্যি প্রশংসনীয়৷’’

শরণার্থীদের পাশে
বছর কুড়ির এরিকা একজন স্বেচ্ছাসেবী৷ গত বছর থেকেই তিনি বার্লিনে রয়েছেন, তবে তার শিকড় কিন্তু রাশিয়ায়৷ শরণার্থীদের সাহায্য করতে প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা স্টেশনে থাকছেন তিনি৷ ডয়চে ভেলেকে এরিকা বলেন, ‘‘বেশিরভাগ শরণার্থী অসম্ভব শ্রান্ত, ক্লান্ত৷ অনেকেই ট্রমায় রয়েছেন৷ কী করতে হবে বুঝতে পারছেন না৷ নির্দিষ্ট দিশা পেতে একজনকে প্রয়োজন তাদের৷ আমরা যতটা পারছি সাহায্য করছি তাদের৷’’

প্রথম দিন থেকে এরিকার মতো অনেকেই রয়েছেন বার্লিন স্টেশনে৷ একাধিক সংগঠন যেমন বার্লিন সিটি মিশনও পাশে দাঁড়িয়েছে৷ সংস্থাটির পক্ষ থেকে বারবারা ব্রুয়ার বলেন, ‘‘বার্লিনবাসীকে নিয়ে আমি গর্বিত৷ অনেকেই ছুটি নিয়ে এসেছেন মানুষের পাশে থাকতে৷ স্বেচ্ছাসেবীরা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে চলেছেন৷ যারা এসে পৌঁছাচ্ছেন, তারা চাইছেন কারো সঙ্গে কথা বলতে, নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে৷’’

ফেলে আসা বাড়ি
বার্লিন সিটি মিশনের তাঁবুতে রুসলান এসের সঙ্গে কথা বলেছিল ডয়চে ভেলে৷ স্বেচ্ছাসেবীদের দেয়া ফলের রস বা জুস পেয়েছেন রসলান৷

তিনি জানান, ইউক্রেনে রীতিমতো আতঙ্কে ছিলেন৷ চোখের সামনে নিজের শহরকে ধ্বংস হতে দেখেছেন তিনি৷ নিজের আত্মীয়দের জন্য তিনি উদ্বিগ্ন৷

স্লোভাকিয়া হয়ে রুসলান ও তার পরিবার জার্মানিতে এসে পৌঁছেছেন৷ এক রাত কেটেছে গির্জায়৷ জার্মানি এসে শান্তি পেয়েছেন, এমনটা জানান তিনি৷ দেশে ফিরতে এই মুহূর্তে চান না৷ তার কথায়, ‘‘সবকিছু শেষ করে দিয়েছে৷ কী হবে কেউ জানে না৷ আমার পরিবার ইউক্রেনে সুরক্ষিত নয়৷’’

তাঁবুতে একমাত্র পুরুষ রুসলান৷ তিনি বয়স্ক হওয়ায় এখানে আসতে পেরেছেন। ইউক্রেনীয় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি কোনো পুরুষ যুদ্ধের সময় দেশ ছাড়তে পারবেন না৷ সবাইকে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে সরকার৷ রুসলানের চাচাত ভাই ভ্লাদ অ্যামেরিকা থেকে জার্মানি এসেছেন পরিবারের সবার পাশে থাকতে৷ কিন্তু তার কাছের আরও দুই চাচাত ভাই ইউক্রেনের থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেননি৷ ভ্লাদ বলেন, কী যে হবে তারা বুঝতে পারছেন না৷

একের পর এক ইউক্রেনীয়দের বাস এসে থামছে বার্লিনে৷ পোল্যান্ড থেকে ট্রেন আসছে৷ তাঁবু ফাঁকা হয়ে গেলেও শরণার্থীরা এসে পৌঁছাচ্ছেন৷ খালি তাঁবু ভর্তি হতে হয়তো বেশি সময় লাগবে না৷

SHARE THIS ARTICLE