ভাষ্কর্য্যের আলাপন

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ দেশে বিদেশে ভ্রমণ করে আমরা প্রায়শঃ বিভিন্ন ধরনের মূর্তি কিংবা ভাষ্কর্য্যের সাহ্নিধ্যে আসি। কিছু কিছু ভাষ্কর্য্য আমাদের মনে নান্দিকতা আনে, কিছু কিছু ভাষ্কর্য্য আমাদের ইতিহাসের পাতায় নিয়ে যায়, কিছু কিছু ভাষ্কর্য্য ঐতিহ্যের কথা বলে আর কিছু ভাষ্কর্য্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় তিক্ত অতীতের কথা। আজ আমরা কিছু ভিন্ন ধর্মী ভাষ্কর্য্যের কথা বলবো যারা কিছু গভীর চিন্তা চেতনার কথা বলে, যারা মূল্যবোধরে কথা বলে। আপনি শুনতে ইচ্ছুক হলে ভাস্কর্যগুলিতে ভাগ করার জন্য খুব ভাল ভাল গল্প রয়েছে।

১।  নাইফ এঞ্জেল (ছুরির দেবদূত) 

আলফি ব্র্যাডলি নামের এই ভাস্কর ১ লক্ষেরও বেশি ছুরি দিয়ে ২৭ ফুট উঁচু শ্বাসরুদ্ধকর এই দেবদূতের মূর্তি তৈরি করেছেন। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অপরাধের সাথে সম্পৃক্ততা থেকে জব্দকৃত ছুরিকে এখানে ব্যাবহার করা হয়েছে। ভাস্কর্যটি বিশেষত সহিংস আচরণের নেতিবাচক প্রভাবগুলি তুলে ধরে তৈরি করা হয়েছে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য। হিংসাত্মক এবং আক্রমণাত্মক ছুরি অপরাধের সমস্যাটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এই অস্ত্রগুলি কতটা বিপজ্জনক তা দেখিয়ে দিয়ে সমাজকে সচেতন করাই এই ভাষ্কর্য্যের লক্ষ্য। 

২। পাসার থ্রু ওয়ালস (দেয়াল অতিক্রমে পথিক)

ফরাসী লেখক মার্সেল আয়েমের উপন্যাস লে পাসে মুরেলের গল্প অবলম্বনে এই মূর্তি নির্মিত হয়েছে। উপন্যাসের গল্পটি এরকম; একজন লোক অফিসে কাজ করে, হঠাত একদিন সে অনুভব করতে পারে যে তার মধ্যে ঐশী শক্তি এসেছে যা দিয়ে সে দেয়ালের ভিতর দিয়ে সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে। এই শক্তি পেয়ে সে মানুষকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে কিন্তু অচিরেই সে অন্ধকার জগতের সাথে যুক্ত হয়ে চুরি করতে শুরু করে, জেলে যায় এবং সহজেই দেয়াল ভেদ  করে বের হয়ে আসে; কিন্তু এভাবে একদিন সে তার ঐশী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে দেয়ালের মাঝখানে আটকে যায়। 

৩। বিল্ডিং ব্রিজেস (সেতু নির্মান)

আমরা আমাদের বিশ্বকে বসবাসের জন্য কিভাবে আরও ভাল জায়গা করে তুলতে পারি? বন্ধুত্ব, প্রজ্ঞা, সহায়তা, বিশ্বাস, আশা এবং ভালবাসা – বিখ্যাত ইতালীয় শিল্পী লরেঞ্জো কুইন অনুসারে এগুলি হ’ল উন্নত বিশ্বের এবং সুখী মানুষের উপাদান। এই ৬ টি ভালো কাজ ৬ জোড়া হাতে মূর্ত হয়ে একসাথে একটি সেতু তৈরি করে। 

৪। কর্পোরেট হেড (কর্পোরেট মাথা)

আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত চিত্তাকর্ষক ব্রোঞ্জের এই ভাস্কর্য এক ব্যবসায়ীকে মূর্ত করে তুলেছে, যিনি নিজের এবং নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভের আশায় নিজের সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই মূর্তিটি দেখাচ্ছে যে, তিনি তার মাথা পুরোটাই তার প্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, বাহিরে কেবলমাত্র দেহটা আছে।ভাস্কর্যটি আধুনিক জীবনের চিত্র তুলে ধরেছে যেখানে লোকেরা নেশার মত তাদের পুরো জীবন অর্থ-বিত্তের জন্য বিলিয়ে দিচ্ছে কিন্তু জীবনের আরও অনেক গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয়গুলো তারা হারিয়ে ফেলে।

৫। স্ফিয়ার উইথিন এ স্ফিয়ার (গোলকের মধ্যে গোলক) 

এই মূর্তিটি ভাঙা গোলকগুলির একটি জটিল কাঠামো – বাইরের এক গোলক এবং অভ্যন্তরীণ অন্য একটি- এবং তার অভ্যন্তরে অসংখ্য জটিল যন্ত্রপাতি, দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে। শিল্পী, আর্নাল্ডো পোমোডোরো তাঁর কাজের মধ্যে সাধারণ জ্যামিতিক ফর্মগুলি অধ্যয়ন করতে পছন্দ করেছেন এবং এই সাধারণ ফর্মগুলির পিছনে গভীর অর্থ লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। গোলকটির মধ্যে একটি গোলক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুই কীভাবে পরস্পর সংযুক্ত, আমাদের পৃথিবী কতটা নাজুক এবং কত সহজেই এটি টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। 

৬। দা ম্যান হু মেজার্স দা ক্লাউড (মেঘ মাপা মানুষ)

এই অনন্য শিল্পকর্মটি তৈরি করেছেন ন্যাপলসের জান ফেবর; ২৯.৫ ফুট উচ্চতায়, একজন মানুষ মেঘ মেপে দেখার চেষ্টা করছে। এই ভাস্কর্যটি অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য মানুষের মরিয়া প্রয়াস হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, মানবজাতি হিসাবে নিজেকে অতিক্রম করার অদম্য প্রচেষ্টা কখনও শেষ হবার নয়।

৭। দা বাংকারস 

জেসন ডিক্লেয়ার টেইলারের পানির নীচে তৈরি করা এই মুর্তি; গত ২০ বছরে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রজন্মের একটি রূপ; প্রযুক্তিগতভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে এবং ভৌগলিকভাবে এটি আমাদের ক্ষতির অন্তর্নিহিত ধারণাটি রেখে গেছে।

৮। এবজোর্বড বাই লাইট (আলোতে শোষিত) 

৩ জন বেঞ্চে বসে, তাদের স্মার্টফোনগুলিতে এতটাই নিমগ্ন যে তারা পাশের পৃথিবীকে লক্ষ্যও করেনা, জানতেও পারেনা। বর্তমান যুগে এর চেয়ে ভাল উদাহরণ আর কী হতে পারে? আমস্টারডাম লাইট ফেস্টিভ্যালের অংশ ছিল এমন ইনস্টলেশনটি একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি কীভাবে আমাদেরকে সংযুক্ত করে এবং সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় তার প্রতীক। এর পর রাতে আপনি যখন হাঁটেন তখন চারপাশে তাকান এবং আপনি একই চিত্র দেখতে পাবেন – চারপাশে কয়েক ডজন মানুষ তাদের মোবাইল ফোনে মুখোমুখি জ্বলজ্বল করে। আমরা আসলে এই আলোগুলো দ্বারা শোষিত হয়েছি, তাই না?

৯। ট্রেইন্স অব লাইফ (জীবনের রেলগাড়ি)
 

ফ্রাঙ্ক মাইসলারের এই ভাষ্কর্য্যটি জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত এবং এর দুটি অংশ রয়েছে – একদিকে অন্ধকার ব্রোঞ্জের ছেলে-মেয়েদের ৫ জন এবং অন্যদিকে হালকা ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। স্মৃতিসৌধের এই একেক অংশের বাচ্চারা জীবনের ভিন্ন দিক দেখেছে। এখানে দেখানো হয়েছে হলোকাস্টের সময় ৫ জনের এই গ্রুপ ১৫ লক্ষ ইহুদি শিশুদের কথা বলে যাদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছিলো আর অন্যদিকে ২ টি শিশু  প্রতিনিধিত্ত্ব করে সেই ১০,০০০ শিশুকে যাদের ইংল্যান্ডে স্থানান্তর করা হয়েছিলো। 

১০। দা মিরাকুলাস জার্নি (অলৌকিক ভ্রমণ) 

কাতারের রাজধানী দোহার সিড্রা মেডিকেল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের বাইরে ১৪ টি বৃহত আকারের ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য রয়েছে, যার প্রতিটি মানব গর্ভে ভ্রূণ থেকে শিশুর বৃদ্ধির একটি ক্রম দেখায়। অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সাহসী হওয়ার কারণে, মিরাকুলাস জার্নি দর্শকদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল এবং কিছু সময়ের জন্য জনসাধারণের দৃষ্টির আড়ালে ছিল। এই ভাষ্কর্য্যের নির্মাতা ড্যামিয়েন হার্স্ট তাঁর কাজের সম্পর্কে বলেছিলেন: “একটি শিশু জন্মের আগে যে যাত্রাটি করে তা তার সমগ্র জীবনে অর্জিত অভিজ্ঞতার চেয়ে বড়। আমি আশা করি, মানব জন্মের এই অসাধারণ প্রক্রিয়া দেখে দর্শক প্রচণ্ড অবাক হয়ে যাবেন এবং শিগগিরই সিড্রা মেডিকেল সেন্টারে ঘটবে অস্বাভাবিক দর্শনার্থির ভিড়।” 

মন্তব্যঃ এর মধ্যে কোন ভাষ্কর্য্যটি আপনি নিজের চোখে দেখতে চান? আপনি আমাদের সাথে কোনও ভাস্কর্য চিত্র বা একটি স্মৃতিসৌধের ছবি ভাগ করে নিতে পারেন যা আপনাকে মুগ্ধ করেছে?

SHARE THIS ARTICLE