আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ব্যক্তি যখন এ দুনিয়ায় তার যাত্রা পথ পাড়ি দেয়, তখন এর গতিপথগুলো তাকে নানা দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যায় এবং লক্ষ্যগুলো জটিলতায় ঘেরা পায়। ফলে সে কিছু সময়ের জন্য থেমে যায়, সে চিন্তা করে তার পদচিহ্নের প্রভাব সম্পর্কে এবং তার দীর্ঘ যাত্রার পথটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে। এ মুহূর্তে তাকে বিস্ময়, দুঃখ ও আনন্দের মিশ্র অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলে। বিস্ময় এ কারণে যে দিনগুলো সুতোর মতো দ্রুত ফুরিয়ে যায় এবং বছরগুলো কিভাবে সমাপ্ত হয়ে যায়। দুঃখ তার অতীত জীবন ও অতিবাহিত সময়ের জন্য, যেখানে অবহেলা, ত্রুটি ও সময় অপচয়ের চিহ্ন রয়েছে। আর আনন্দ হয় তার সফলতা ও লক্ষ্য পূরণের জন্য।
এটি একটি দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত, আনন্দময় ও বেদনাদায়ক এবং হাস্যকর ও দুঃখজনক যাত্রা; দীর্ঘ তার ঘটনা প্রবাহের কারণে।
কিন্তু পথিক যখন তার গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে, তখন তা সংক্ষিপ্ত মনে হয়। যাতে রয়েছে জয়-পরাজয়, সুখ-দুঃখের অশ্রু, বিশ্রাম ও ক্লান্তি, মিলন ও বিচ্ছেদ, উত্থান ও পতন। এটাই এ জগতে আল্লাহর নির্ধারিত বিধান, যেমন তিনি বলেছেন, ‘তোমরা জেনে রাখ যে, দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য, তোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহঙ্কার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উইমা হলো বৃষ্টির মতো, যার উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ দেয়, তারপর তা শুকিয়ে যায়, তখন তুমি তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাও, তারপর তা খড়কুটায় পরিণত হয়। আর আখিরাতে আছে কঠিন আজাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবন প্রতারণার সামগ্রী ছাড়া কিছু নয়।’ (সুরা আল-হাদিদ: ২০)
এটি জীবনের পরিবর্তনশীল যাত্রা, যা কখনোই একটি অবস্থার ওপর স্থির থাকে না। এটি আমাদের নিয়ে চলে, যখন একটি দিক শক্তিশালী হয়, তখন সহজ থেকে কঠিন পথে নিয়ে যায়। এটি যেন অন্ধকারে থাকা গ্রহগুলোর একটি গ্রহ, যা একইভাবে চলে ও প্রবাহিত হয়।
এটি যদিও একটি দীর্ঘ যাত্রা, যা মানুষের পৃথিবীতে প্রবেশ থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর পর মাটির নিচে চলে যাওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে, তবুও এটি ঘুমন্ত মানুষের স্বপ্নের মতো, যখন সে ঘুম থেকে জাগে এবং অবচেতনতা থেকে বের হয়। এটি যেন এক জন অতিথির অস্থায়ী থাকার মতো অথবা একটি স্বপ্নের ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতির মতো।
মুমিনের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্কের নবীজির সেই তুলনা কতই না সুন্দর ও মনোহর। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) একদা একটি চাটাইয়ের ওপর ঘুমিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি তা থেকে উঠলে তাঁর শরীরে এর দাগ পড়ে যায়। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! যদি আমরা আপনার জন্য একখানা বিছানা তৈরি করে বিছিয়ে দিই।’ তিনি বললেন, ‘দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আমি তো এ জগতে ওই আরোহীর মতো যে একটি গাছের নিচে ছায়ায় কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিল, অতঃপর বৃক্ষটিকে ছেড়ে চলে যায়।’ (সুনানে তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)
ইমানদার ভাইবোনরা, যখন একজন মুমিন বান্দা এ জীবনের উত্তাল সমুদ্রের মাঝ দিয়ে চলে, যেখানে তরঙ্গগুলো তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে যায় এবং ঢেউগুলো তাকে ধাক্কা দেয়, তখনো সে মানসিক স্থিতিশীলতা ও আধ্যাত্মিক শান্তি উপভোগ করে; কারণ তার অন্তর এ জগতের স্রষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁর ভালোবাসায় মন পরিপূর্ণ এবং তাঁর তাওহিদ দ্বারা হূদয় প্রতিষ্ঠিত। তাই দুনিয়ার সংগ্রাম তার কাছে একটি বাহ্যিক লড়াই, অভ্যন্তরীণ নয়; এটি সে চোখে দেখে, কিন্তু তার অন্তরে ঠাঁই দেয় না।
সত্যিকারের ইমান এ জীবনের ক্লান্তি ও উত্তেজনার মধ্যে মনের গভীরে শান্তি ও নিরাপত্তা নিয়ে আসে, আনন্দ ও নিশ্চয়তা প্রদান করে। এটি জীবনের মরুভূমিতে হূদয়ের জন্য বসন্ত, উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে শীতল ছায়া এবং এ পৃথিবীর গভীরতা থেকে মুক্তির কিশতি। যদিও মুমিন বান্দা জীবনযাত্রার কঠিনতা এবং দুনিয়ার প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়, তবুও তার হূদয় প্রশান্ত, মুখে হাসি, চেহারায় প্রশান্তি, মন শান্ত এবং ভাষা মিষ্টি থাকে। তার কষ্ট ও বিপদ যতই বাড়ে, তাতে তার সওয়াবই বৃদ্ধি পায়। যেমন একটি চন্দন কাঠ পোড়ানোর পরও তার সৌরভ আরো বৃদ্ধি পায়।
দুনিয়ার এ সংগ্রামের মধ্যেও ইমান হচ্ছে হূদয়ের সান্ত্বনা, আত্মার সুখ এবং অন্তরের আনন্দ। যে ব্যক্তি ইমানের প্রবাহিত স্রোতে নিমজ্জিত না হয় এবং এর সুধা পান না করে, সে জীবনের মিষ্টতা ও সুখ আস্বাদন করতে পারবে না। যখন তার আত্মা এ স্রোত থেকে পান করে পরিতৃপ্ত হয়, তখন তার সত্তা রঞ্জিত হয় এবং সেই সুধা তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে আর তার চেহারায় সেই সতেজতা প্রকাশ পায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, অবশ্যই আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আর অবশ্যই আমি তাদেরকে তারা যা করত তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ প্রতিদান দেব।’ (সুরা আন-নাহল: ৯৭)
নিশ্চয় ইমানসমৃদ্ধ জীবন হলো পবিত্র, সম্মানজনক ও প্রশান্তিময় জীবন; যার সামনে পাহাড়সম বিপদ ও দুর্দশাকে তুচ্ছ মনে হয় এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের স্তূপকে মূল্যহীন মনে হয়। আর ইমানের বিশেষ স্বাদ রয়েছে, যেমনটি প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন। বস্তুত যার অন্তরে ইমান সুদৃঢ় হয়েছে আনুগত্য ও স্বীকৃতির দিক থেকে এবং ইমানের বাস্তবায়ন করেছে এর প্রতি বিনয়ী হয়ে ও আত্মসমর্পণ করে সে অন্তরে ইমানের স্বাদ অনুভব করবে এবং হূদয়ে তার প্রভাব অনুধাবন করবে; যার স্বাদ বর্ণনাতীত ও তার হাকিকত কোনো বাক্য বা শব্দে ব্যক্ত করা অসম্ভব। বরং তা এমন বাস্তবতা যা কেবল ইমানদার ব্যক্তিরাই উপলব্ধি করে এবং আল্লাহর খাস বান্দারাই অনুধাবন করে থাকে।
দ্বিতীয় খুতবা
মুমিন নর ও নারীগণ! নিশ্চয় প্রকৃত ইমান বাস্তবতা বিবর্জিত কোনো অর্থের নাম নয়, অথবা এমন কোনো মতবাদ নয় যার বাস্তবিক জীবনে কোনো প্রয়োগ নেই।
বরং তা এমন বিশ্বাস যার মাধ্যমে অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, যার ফলে হূদয়ে প্রশান্তি, আস্থা, সন্তুষ্টি ও আনন্দ বয়ে যায়। অতঃপর তা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আমল ও পরিপালনে ব্যাপৃত করে। পরিশেষে এর পরিধি বৃদ্ধি পেয়ে সমগ্র মানবজাতির ওপর নিরাপত্তা, শান্তি, ভালোবাসা, কল্যাণ ও ইনসাফ প্রবাহিত করে। মূলত তা মুমিনকে জীবনের ক্ষণস্থায়ী লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠিয়ে মানবিক পূর্ণতার শিখরে উন্নীত করে।
এ মহান ধর্ম মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি, হূদয়-আত্মা ও আচরণগত দিক থেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য এসেছে; যাতে মানুষ এ মহাবিশ্বে দৃঢ় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং মানসিক, আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতার অধিকারী হতে পারে। ব্যাপক অর্থে, ইমান হলো সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সৃষ্টির সংযোগ স্থাপন করা এবং দৃশ্যমান জগতের সঙ্গে অদৃশ্য জগতকে সম্পৃক্ত করা।
অনুরূপভাবে ইমান আল্লাহর নিকট এ সম্মানিত সৃষ্টিকে তার আত্মা, রূহ, আচরণ ও নৈতিকতার মধ্যে পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম করে তোলে; ফলে আল্লাহ তায়ালার মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়।
ফলস্বরূপ ইমান এ মানুষকে মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তিতে পূর্ণ করে দেয়; এ পৃথিবীকে উন্নত করা এবং এখানে বিশ্ববাসীর মাঝে কল্যাণ, ইনসাফ, ভালোবাসা, শান্তি ও দয়া বিস্তার করার পূর্বেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তো আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য শুধু রহমতরূপেই পাঠিয়েছি।’ (সুরা আল-আম্বিয়া: ১০৭)
৩০ আগস্ট ২০২৪ মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার ভাষান্তর— হারুনুর রশীদ ত্রিশালী