মহামারীতে ৫০ লক্ষের বেশী মানুষের মৃত্যু দেখলো বিশ্ববাসী


More Than 1 Million People Have Died From COVID-19 Worldwide : Goats and  Soda : NPR


ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ আজ এক বিশেষ দিন, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুসারে আজ ১লা নভেম্বর ২০২১ সোমবার, কোভিড-১৯ থেকে বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষ অতিক্রম করেছে। আজ সোমবার সকাল ৪:৫০ মিনিটে জন হপকিনসের ওয়েব সাইটে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ লক্ষ ৪২৫ দেখিয়েছে। জন হপকিন্স দেখিয়েছে যে, গত ২৮ দিনে বিশ্বব্যাপী কোভিডে মারা গেছেন ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ১১৬ জন। ২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের উহান শহরে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে করোনভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ২৪ কোটি ৭৬ লক্ষ ৭০ হাজার।

Graphic showing the number of deaths worldwide is five million, up 4,601 in the latest 24-hour period. The number of cases is 246.7 million, up by 306,608 in the latest 24-hour period. Updated 1 Nov

দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মহামারির কারণে মৃত্যুর এবং সংক্রমণের এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে পরাজয় এবং ব্যার্থতার অসামান্য গ্লানি। এই পরাজয়ে শুধুমাত্র দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোই নয়, ধনাঢ্য দেশসমূহ, যারা বিগত কয়েক যুগ থেকে তাদের স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে গর্বিত ছিলেন তারা বিপর্য্যস্ত হয়েছেন সর্বাধিক, হয়েছেন সম্পুর্ন পরাজিত।  

আমরা যদি ভালো করে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং ব্রাজিল – এই চারটি অঞ্চল যারা মূলত উচ্চ-মধ্য বা উচ্চ-আয়ের দেশ, এই অঞ্চলে বাস করেন বিশ্বের জনসংখ্যার আট ভাগের এক ভাগ মানুষ; সেই দেশগুলোতে মৃত্যু বরণ করেছেন বিশ্বের মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক মানুষ।

শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭ লক্ষ ৪৫ হাজারের বেশী মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যা একটি রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বে সর্বাধিক। ব্রাজিলের অবস্থান দ্বিতীয়, সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৬ লক্ষের বেশী মানুষের, মৃত্যুর পরিসংখ্যানে এর পরের অবস্থানে রয়েছে ভারত, সেখানে ৪ লক্ষ ৫৮ হাজারের বেশী জীবণ চলে গেছে, কোভিডের কারণে।

২২ মাসে এই ৫০ লক্ষ জীবনের অবসান সভ্যতার ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ বলেই আমাদের মনে হয়। এখনো এই মহামারি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের যেন আর এ ধরনের কোন ক্রান্তিলগ্নে না পৌঁছাতে হয়। আমরা ভাবলে দেখবো ৫০ লক্ষের এই সংখ্যা আয়ারল্যান্ড নামক দেশটির পুরো জনসংখ্যার সমান। যুক্তরাজ্যের পুরো দেশের জনসংখ্যার ১৩ ভাগের এক ভাগ। বিশ্বব্যাপী, কোভিড-১৯ এখন হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের পরে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ।

উন্নত বিশ্বের পরিসংখ্যান অনেকটাই প্রকৃত মৃত্যুর কাছাকাছি হলেও দরিদ্র বিশ্বে সীমিত পরীক্ষার সুযোগ এবং চিকিৎসার অপ্রতুলতার কারণে অনেক মৃত্যুই এই পরিসংখ্যানে অন্তর্গত হয়নি। তাই আমরা মনে করি মৃত্যুর এই প্রকাশিত পরিসংখ্যাণের চেয়ে আরও অনেক বেশী মানুষ কোভিডের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন যাদের কোন রকম পরিসংখ্যান আমরা কখনই পাবনা।

What a US exit from the WHO means for COVID-19 and global health

গত বৃহস্পতিবার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছিল যে বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ এবং মৃত্যু গত দুই মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম ঘেব্রেইসাস বলেছেন যে এই বৃদ্ধির মূল কারণ ইউরোপে চলমান সংক্রমণের বর্ধিত হার।

টেড্রোস বলেন,”এটি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, মহামারী এখনও শেষ হয়নি। অন্য জায়গায় যে হারে কমছে সেই হারের থেকে বেশী মাত্রায় ইউরোপে এই সংক্রমণ বাড়ছে।” মহামারী এখনো টিকে থাকার মূল কারণ হিসাবে তিনি সুযোগ সুবিধার অসম বিতরণকে দায়ী করে বলেন, “নিম্ন-আয়ের দেশগুলির তুলনায় উচ্চ-আয়ের দেশগুলিতে ৮০ গুণ বেশি পরীক্ষা এবং ৩০ গুণ বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে।”

Gwamnatin Biden ta sanya wa Rasha takunkumi | Labarai | DW | 02.03.2021

সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই দ্রুত এই ভাইরাসের হটস্পট পরিবর্তন হয়েছে। চীন থেকে শুরু হয়ে ইটালি, ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, ব্রাজিল, ভারত এসকল দেশই এক সময় ছিল হটস্পট, মানচিত্রে লাল চিহ্ন। বিশেষ করে টিকা প্রদান শুরু হওয়ার পর এই সংক্রমণের চিত্র আবারো নূতন রূপ ধারণ করেছে। এই মুহুর্তে কোভিড মহামারি শুরু হওয়ার ২২ মাস পর ভাইরাসটি রাশিয়া, ইউক্রেন এবং পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে আঘাত হেনেছে। গতকাল রাশিয়ায় একদিনে ৪০, ৯৯৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ১১৫৯ জন। এটা ছিল পুরো কোভিড মহামারিতে রাশিয়ায় আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড।

Information for young people on coronavirus vaccination | HSC Public Health  Agency

রাশিয়া যদিও বিশ্ব মানচিত্রে সবার আগে টিকা দেওয়া শুরু করেছিলো আনুষ্ঠানিভাবে কিন্তু টিকা শুরুর ১০ মাসের বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তারা সম্পুর্ন দুই ডোজ টিকা দিতে পেরেছে দেশটির মাত্র ৩৩% মানুষকে । ইউক্রেন দিতে পেরেছে মাত্র ১৭% মানুষকে। আরমেনিয়া দিতে পেরেছে মাত্র ৭% মানুষকে। এই মুহুর্তে টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী এগিয়ে আছে আয়ারল্যান্ড, এখানে সমগ্র জনগোষ্ঠীর ৭৫% শতাংশ মানুষকে দুটি ডোজ টিকা দিয়ে দেয়া হয়েছে। এব্যাপারে বাংলাদেশ দিয়েছে ১৭.৪% আর ভারত দিয়েছে ২৩.৮% (আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা, ২৭শে অক্টোবর)।

আমরা লক্ষ্য করেছি যে, এই ভাইরাসটি উচ্চ সম্পদশালী দেশগুলোতে আক্রমণ করেছে সবচেয়ে বেশী। এই সকল দেশের জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বয়স্ক, ক্যান্সার থেকে বেঁচে যাওয়া এবং নার্সিং হোমের বাসিন্দা, আর এরাই আক্রান্ত হয়ে জীবন হারিয়েছেন সবার আগে। কম সম্পদশালী দেশগুলোতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা অনেকাংশে কম এবং সেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ তরুণ, যুবক এবং সেই সকল দেশে মানুষের মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে।

Uncovering why the COVID-19 Delta Variant is exceptionally infectious

যদিও এই ধারনার বিপরীত দিক আমরা দেখেছি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বেলা। এই পরিবর্তীত ভাইরাসটি সবচেয়ে বেশী আঘাত হেনেছিল ভারতে। এই বছরের মে মাসের প্রথম দিকে ভারতে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার শীর্ষে   পৌঁছেছিলো। ভারতের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা পুরোটাই বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। অক্সিজেন এবং হাসপাতালে বেড না থাকায় বিনা চিকিৎসায় অনেকেই মৃত্যুবরন করেছেন। বাংলাদেশেও এই ডেল্টা ভ্যারাইটি হানা দিয়েছিলো, তবে ভারতের তুলনায় কম বিপর্য্যস্ত হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা। ভারত এবং বাংলাদেশে এই সংক্রমণের ধারা এখন কমে এসেছে আর বেড়েছে রাশিয়া, ইউক্রেন এই সমস্ত দেশে। তবে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে সংক্রমণের হার একেবারে না কমে আবার বাড়ছে। মনে করা হচ্ছে টিকা প্রদানে সফলতার কারণে এই সকল দেশে মারাত্নক অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা এবং মৃত্যুর হার অনেক কমে এসেছে।

বিশ্বের দিকে সাধারণভাবে তাকালে বোঝা যায় যে, এই ভাইরাসের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশী বিপর্য্যস্ত হয়ে ধনাঢ্য দেশের জনগণ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় প্রাণ হারিয়েছে আর সেই তুলনায় কম সম্পদশালী দেশে মৃত্যু কিংবা সংক্রমণের সংখ্যা কম। তবে এই সকল সম্পদশালী দেশের অভ্যন্তরে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় দেশগুলোর অভ্যন্তরে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন দরিদ্র এলাকায় বসবাসকারী জনগণ। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, এই মহামারিতে কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিক লোকরা সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয়েছেন। এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করার সম্ভাবনা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে বেশি এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ তাদের জন্য সীমিত।

সুতরাং আমরা সম্পদের সাথে মহামারি সংক্রমণ কিংবা মৃত্যুর চিত্রে বেশ বৈপরীত্য দেখতে পাই। একদিকে যেমন কম সম্পদশালী দেশ আক্রান্ত হয়েছে কম অন্যদিকে সম্পদশালী দেশে কম বিত্তবানরা আক্রান্ত হয়েছে বেশী। আবার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বেলা বিত্তবান কিংবা কম বিত্তবান উভয়েই আক্রান্ত হয়েছেন।

COVID Vaccine Politics: Why Worst Hit States May Get Least Vaccine Doses |  OPINION

আমরা যদি আবার টিকার ব্যাপার নিয়ে পর্য্যবেক্ষন করি তাহলেও একটি বিরাট বৈপরীত্য দেখতে পাবো। টিকার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বার্বজনীন টিকা বিতরণের উদ্যোগের কথা বললেও বিত্তবান দেশগুলো দ্রুত বিশ্বের সকল টিকা আগেভাগেই কিনে ফেলে এবং দেশগুলোর বেশীরভাগ মানুষ ইতিমধ্যে টিকার দুই ডোজ দেয়া সম্পন্ন করে ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসারায়েল সহ কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে তৃতীয় বুস্টার দিচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো টীকা প্রদানে পিছিয়ে আছে অনেক। সারা আফ্রিকা জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনো এক ডোজ টিকা পায়নি, যদিও ধনী দেশগুলো কয়েক কোটী ডোজ টিকা প্রদান করেছে। আফ্রিকা এখন সবচেয়ে কম টিকাপ্রাপ্ত অঞ্চল, ১৩০ কোটী মানুষের মাত্র ৫% মানুষ টিকার দুটি ডোজ পেয়েছেন। 

Share your story: Has the pandemic changed your life for the better?

টিকা প্রদানে অগ্রগামী দেশগুলো তাদের দেশ অনেকটাই খুলে দিয়েছেন, যারা টিকা প্রদানে ততটা অগ্রগামী নয় তারাও খুলে দিয়েছেন, বিধি নিষেধ শিথিল করে দিয়ে ভাইরাসের সাথে জীবন পরিচালনার পথ খুঁজছেন। এমতাবস্থায় কিছু কিছু দেশে সংক্রমণ আবার বাড়ছে, মৃত্যুও বাড়ছে। যেভাবে মনে করা হয়েছিলো টিকা আবিষ্কার এবং হার্ড ইমিউনিটি বিশ্ববাসীকে এই মহামারির কবল থেকে মুক্তি দিবে, সেই আশায় পানি ঢেলে দিয়েছে ইউরোপ বিশেষ করে রাশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি। এমতাবস্থায় দেশে দেশে মানুষ দীর্ঘদিন ঘরে বন্দী থেকে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছে, তারা আর ঘরে ফিরে যেতে চায়না। দেশে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চাঙা হতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় আবার লক ডাউনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে কি হবে তা বোঝা দায়। আপাতদৃষ্টে, মানুষ চাইছেনা আর গৃহবন্দী হতে।

No profit on pandemic. Everyone deserves protection from COVID-19.

আজ ৫০ লক্ষ জীবনের আত্নাহূতিতে আমাদের উপলব্ধি হচ্ছে, এই মহামারি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, সারা বিশ্ব একটি দেশ। বিভক্ত হয়ে সম্পদ কুক্ষিগত করে কেউ একা এই ধরনের মহামারিতে বেঁচে থাকতে পারবেনা। যদি প্রথমেই টিকাকে সার্বজনীন করে সারা বিশ্ববাসিকে এক সাথে টিকা দেবার সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হতো তাহলে সারা বিশ্ব এই মহামারি থেকে সুরক্ষা পেতে পারতো। এখনো সময় আছে, সার্বজনীন এবং সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে সারা বিশ্বকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা হলেই এই মহামারী থেকে আমরা সকলেই সুরক্ষিত হবো। অন্যথায় ঘুরে ফিরে ভাইরাস আবার  আমাদের দুয়ারে হানা দিবে। 

SHARE THIS ARTICLE