
আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ মৃত্যুর পর শরীর দান করা—যেমন অঙ্গ দান বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য—ইসলামে হালাল (বৈধ) কিনা, তা নির্ভর করে পরিস্থিতি, ইসলামী নীতি এবং আলেমদের ব্যাখ্যার উপর। ইসলামী শিক্ষার আলোকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা নিম্নে দেওয়া হলো:
ইসলামী নীতি
১. মানবদেহের পবিত্রতা: ইসলামে মানবদেহকে আল্লাহর দেওয়া আমানত হিসেবে গণ্য করা হয়, যা জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরেও সম্মানের সঙ্গে রক্ষণীয়। কুরআনে বলা হয়েছে, “আমরা আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি” (সূরা আল-ইসরা, ১৭:৭০)। এই সম্মান মৃত্যুর পরও বজায় থাকে, তাই মৃতদেহের অযথা ক্ষতি বা হস্তক্ষেপ সাধারণত নিষিদ্ধ।
২. জীবন রক্ষার গুরুত্ব: জীবন রক্ষা ইসলামের একটি মৌলিক নীতি। কুরআনে উল্লেখ আছে, “যে একটি প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করে” (সূরা আল-মায়িদা, ৫:৩২)। এই নীতি প্রায়শই অঙ্গ দানের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যখন তা সরাসরি জীবন বাঁচায়।
৩. জরুরতের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শিথিল: ইসলামী ফিকহে জরুরতের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের অনুমতি দেওয়া হয়। যদি কোনো নিষিদ্ধ কাজ বড় ক্ষতি প্রতিরোধ বা উল্লেখযোগ্য উপকার আনতে পারে, তবে তা বৈধ হতে পারে।
মৃত্যুর পর অঙ্গ দান
অনেক সমকালীন ইসলামী আলেম মৃত্যুর পর অঙ্গ দানকে নির্দিষ্ট শর্তে বৈধ বলে মনে করেন:
- সম্মতি: মৃত ব্যক্তির জীবদ্দশায় স্পষ্টভাবে সম্মতি থাকতে হবে, অথবা তার পরিবার তার সম্ভাব্য ইচ্ছা ও ইসলামী নীতি অনুযায়ী সম্মতি দিতে পারে।
- জীবন রক্ষার উদ্দেশ্য: অঙ্গ দানের মাধ্যমে স্পষ্ট চিকিৎসা উদ্দেশ্য পূরণ হতে হবে, যেমন হৃদপিণ্ড, কিডনি বা লিভার প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচানো।
- অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি নয়: দানের জন্য প্রয়োজনীয়তার বাইরে দেহের অসম্মান বা ক্ষতি করা যাবে না।
- ইসলামী দাফন: অঙ্গ সংগ্রহের পর বাকি দেহটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইসলামী নিয়মে দাফন করতে হবে।
শায়খ ইউসুফ আল-কারাদাভির মতো আলেম এবং ইসলামী ফিকহ একাডেমির (অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশনের অধীনে) সিদ্ধান্ত অঙ্গ দানের পক্ষে সমর্থন দেয়। তারা যুক্তি দেন যে, জীবন বাঁচানোর উপকার দেহে হস্তক্ষেপের সাধারণ নিষেধাজ্ঞার চেয়ে বড়, যদি তা সম্মানের সঙ্গে করা হয়।
গবেষণার জন্য পুরো শরীর দান
বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য পুরো শরীর দান (যেমন চিকিৎসা প্রশিক্ষণ বা পরীক্ষার জন্য) বেশি বিতর্কিত:
- বিরোধী যুক্তি: অনেক আলেম মনে করেন, এটি দেহের মর্যাদা লঙ্ঘন করে, কারণ এতে দীর্ঘ সময় ধরে দেহ রাখা, ব্যবচ্ছেদ বা ইসলামী দাফনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উপায়ে নিষ্পত্তি হতে পারে। দ্রুত দাফনের সুন্নাহ এতে বাধাগ্রস্ত হয়।
- পক্ষের যুক্তি: কিছু আধুনিক আলেম এটির অনুমতি দেন, যদি গবেষণাটি সমাজের জন্য জরুরি হয় (যেমন ভবিষ্যতে জীবন বাঁচাতে চিকিৎসা জ্ঞান বৃদ্ধি) এবং ব্যবহারের পর দেহ সম্মানের সঙ্গে দাফন করা হয়। তবে এটি সংখ্যালঘু মত এবং কঠোর শর্তের অধীন।
ব্যবহারিক ইসলামী সমাধান
১. অঙ্গ দানের জন্য: যদি আপনার উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট অঙ্গ (যেমন কিডনি, লিভার) দিয়ে জীবন বাঁচানো হয়, তবে অনেক আলেমের মতে এটি হালাল। আপনার করণীয়:
- আপনার সম্মতি স্পষ্টভাবে লিখিতভাবে রাখুন (যেমন ওয়াসিয়ত বা আইনি নির্দেশে)।
- পরিবারকে জানিয়ে রাখুন এবং তাদের সম্মতি নিশ্চিত করুন।
- শুধু প্রয়োজনীয় অঙ্গ সংগ্রহের শর্ত দিন এবং বাকি দেহ দ্রুত ইসলামী নিয়মে দাফনের নির্দেশ দিন।
২. পুরো শরীর দানের জন্য: গবেষণার জন্য পুরো শরীর দান সাধারণত নিরুৎসাহিত করা হয়, যদি না এটি সমাজের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয় (যেমন চিকিৎসা প্রশিক্ষণের জন্য বিকল্প না থাকা)। এ বিষয়ে স্থানীয় জ্ঞানী আলেম বা ইমামের সঙ্গে পরামর্শ করুন, কারণ এটি সর্বজন গৃহীত নয়।
৩. বিকল্প: অনিশ্চয়তা থাকলে জীবদ্দশায় দান (যেমন রক্ত, কিডনি) বেছে নিতে পারেন, যা নিঃসন্দেহে বৈধ এবং অন্যকে সাহায্যের চেতনা পূরণ করে, মৃত্যুর পর দেহ অক্ষত রেখে।
উপসংহার
জীবন বাঁচানোর জন্য মৃত্যুর পর অঙ্গ দান অনেক ইসলামী কর্তৃপক্ষের মতে হালাল, যদি দেহের সম্মান বজায় থাকে এবং ইসলামী দাফন পালন করা হয়। গবেষণার জন্য পুরো শরীর দান বিতর্কিত এবং প্রায়শই নিরুৎসাহিত, যদি না তা একান্ত জরুরি হয়। আপনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করুন, বিশ্বস্ত আলেমের সঙ্গে পরামর্শ করুন এবং আপনার সিদ্ধান্ত যেন ঈমান ও অন্যের কল্যাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।