আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতনের পর একে একে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেই তালিকায় এবার যোগ হয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি’র সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। সম্প্রতি তিনি পালিয়ে ভারতে চলে গিয়েছেন বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে। ওই সূত্র জানায়, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ভারতের গোয়াতে একটি হোটেলে অবস্থান করছেন। তার সঙ্গে যুবলীগের সাবেক নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটকেও দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর প্রথমে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সবাই ক্যান্টমেন্টে সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। গত ১৮ আগস্ট আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ শাখা (আইএসপিআর) থেকে জানানো হয়, গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দলের নেতা, বিচারক, সরকারি আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় ৬২৬ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ২৮ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৫১৫ জনই ছিলেন পুলিশের সদস্য। আশ্রয়গ্রহীতাদের অধিকাংশই নিজ উদ্যোগে পরে সেনানিবাস ছেড়ে চলে যায়। এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে আশ্রয় নেওয়া চার জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানও সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে ছিলেন। সেখান থেকে বের হয়ে এসে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান তিনি। হাবিব ছাড়াও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামও ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। সম্প্রতি দিল্লির একটি সুপার শপ থেকে মনিরুল ইসলাম নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছেন এমন একটি ছবিও ভাইরাল হয়েছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ পুলিশের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার লালমনিরহাটের সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর ব্যবহার করে সিডনি পালিয়ে গেছেন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউর আলম। এছাড়া পুলিশের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত কর্মকর্তা সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদও পালিয়ে আমেরিকায় গিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। ইতোমধ্যে আমেরিকার একটি সেমিনার কক্ষে বসে আছেন এমন একটি ছবিও ভাইরাল হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুল ইসলাম, সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া, রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি আবদুল বাতেন, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি কৃষ্ণপদ রায়, খন্দকার লুৎফুল কবির, ডিআইজি আসাদুজ্জামান, সৈয়দ নূরুল ইসলাম, মোজাম্মেল হক, ইমাম হোসেন, জয়দেব কুমার ভদ্র ও অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদারও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
এদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন। পরবর্তীতে তারা বিশেষ কৌশলে ও মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পাসপোর্টে ইমিগ্রেশনের সিলও মেরে নিয়েছেন। এছাড়া পুলিশের বিশেষ শাখার ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তাও অনেককে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর থেকে ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিল। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘যেসব পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছে, তাদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মাইনুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিগত সময়ে যেসব পুলিশ অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোপূর্বে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের আমরা গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে থাকা ঊর্ধ্বতন প্রায় সব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক উপ-কমিশনার মশিউর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফিসহ এক ডজন পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তবে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, পুলিশকে যারা রাজনৈতিকীভাবে ব্যবহার করেছে, সেসব কর্মকর্তাকে পালানোর সুযোগ দিয়ে নির্দেশ মানা মধ্যম ও নিম্নস্তরের কর্মকর্তা এবং সদস্যদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এসপির নিচে কোনও কর্মকর্তা বা সদস্য নিজ থেকে কোনও কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না। তারা ঊর্ধ্বতনদের আদেশ প্রতিপালন করেন মাত্র। ঊর্ধ্বতনরা সবাই অবৈধভাবে বিপুল সম্পদেরও মালিক হয়েছে। আবার তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগও করে দেওয়া হয়েছে।
বিপ্লব কুমার সরকার (ছবি: সংগৃহীত)
প্রায় সবার সম্পদ বিদেশে
পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পুলিশের যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই বিদেশে অবৈধভাবে অর্থপাচার করে বিপুল বিত্ত-বৈভব গড়ে তুলেছেন। এর মধ্যে সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের সব অর্থ সিঙ্গাপুরে সাবেক এক জাসদ ছাত্রলীগ নেতার হেফাজতে রয়েছে। হারুন অর রশিদ টাকার পাহাড় গড়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। হারুনের স্ত্রী ডিভি লটারির মাধ্যমে আমেরিকা যাওয়ার কারণে তিনি বেশিরভাগ অর্থ আমেরিকায় পাঠিয়েছেন। সাবেক ডিআইজি ইমাম হোসেনের থাইল্যান্ডে ব্যবসা রয়েছে। এছাড়া মনিরুজ্জামান ও বাতেনসহ অন্যরাও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিনিয়োগ করে রেখেছেন।
পুলিশের ওই সূত্র জানায়, পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা ভারতে অবস্থান করছেন, তারা কোনও কৌশলে যেই দেশে অর্থপাচার করেছেন, সেখানে ঢুকতে পারলে আর দেশে ফিরবেন না। অবৈধভাবে যত অর্থ তারা আয় করেছেন, তা দিয়ে তারা বিলাসী জীবনযাপন করতে পারবেন