আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তৈরি ‘অলাভজনক’ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকম পাঁচ বছরের আইনি লড়াই শেষে কর্মচারীদের দাবি করা ৪৩৭ কোটি টাকা দিতে রাজি হয়েছে৷ এ কারণে ১৭৬ জন কর্মচারীর মামলাও প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট পক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে টাকা দেয়া শুরু হয়েছে এবং আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেয়া শেষ হবে৷ টাকা দেয়া হচ্ছে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মাধ্যমে৷ ১৭৬ জন কর্মচারীর প্রতিজন গড়ে দেড় কোটি থেকে তিন টাকা করে পাচ্ছেন৷
কী নিয়ে মামলা
গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ ফোন দুইটি আলাদা প্রতিষ্ঠান৷ তবে গ্রামীণ ফোনে গ্রামীণ টেলিকমের ৩৪ ভাগেরও বেশি শেয়ার রয়েছে৷ গ্রামীণ টেলিকমে যারা কাজ করেন, তারা চাকরির শর্ত অনুযায়ী লাভের শতকরা পাঁচ ভাগের দাবিদার৷ ২০১১ সালে গ্রামীণ ফোন থেকে যখন গ্রামীণ টেলিকম লভ্যাংশ পাওয়া শুরু করে, তখন থেকে কর্মচারীদের বিরোধ শুরু হয় গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে৷ কর্মচারীরা গ্রামীণ ফোন থেকে পাওয়া লভ্যাংশের পাওনা দাবি করে৷ কিন্তু গ্রামীণ ফোন কর্র্তৃপক্ষ তা দিতে নারাজ ছিল৷ এই নিয়ে কর্মচারীরা প্রতিবাদ ও নানা কর্মসূচি পালন শুরু করেন৷
ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান৷ ২০১৭ সালে গ্রামীণ টেলিকমের ১৭৬ জন কর্মচারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে মোট ১১০টি মামলা করেন৷ এর মধ্যে ৬টি মামলা হয় হাইকোর্টে৷ আর ১০৪টি মামলা হয় শ্রম আদালতে৷ কর্মচারীরা মোট প্রায় ৪৩৭ কোটি টাকা দাবি করে আসছিলেন৷ এই নিয়ে দুই পক্ষই আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন৷ মামলায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছিল ২০১৯ সালের ৯ অক্টোর৷ তখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান রহিবুল ইসলাম৷ তখন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন৷
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতের বাইরে এই বিরোধ নিস্পত্তি হওয়ায় কর্মচারীরা তাদের মামলা প্রত্যাহার করে নেন৷
সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের আদালতে করা গ্রামীণ টেলিকমের অবসান চেয়ে যে আবেদন কর্মচারিদের আইনজীবী করেছিলেন, তা-ও খারিজ হয়৷
কেন টাকা দেয়া হচ্ছে কর্মচারীদের?
গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারীদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘‘গ্রামীণ টেলিকম শেষ পর্যন্ত শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মচারীদের লাভের শতকরা পাঁচ ভাগ দিতে রাজি হয়েছে৷ এ নিয়ে আদালতের বাইরে দুই পক্ষের সাথে চুক্তি হয়েছে৷ সেই চুক্তি অনুযায়ী কর্মচারীরা মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন৷”
‘আসলে চুবানি দিয়েছি আমি’
অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলী আরো বলেন, ‘‘আগেই এই চুক্তি হয়েছে৷ আমি ফেসবুকে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী চুবনি দেয়ার কথা বলার কারণে নাকি এটা হয়েছে৷ এই কথা ঠিক না৷ তার আগেই সেটেলমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে৷ আসলে চুবানি দিয়েছি আমি৷ আমি যখন গত মার্চে কোম্পানি আইনে আদালতে গ্রামীণ টেলিকম অবসানের (উইন্ডআপ) আবেদন করেছি, তার পরের দিনই তাদের আইনজীবী আমাকে ফোন করে সেটেলমেন্টের প্রস্তাব দেয়৷ কারণ, গ্রামীণ ফোনের ৩৪ ভাগ শেয়ার তাদের৷ বছরে তারা এক হাজার কোটি টাকা লভ্যাংশ পায়৷ কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে এই লভ্যাংশ আর তারা পেতো না৷ এটাই হলো আসল চুবানি৷”
‘এর সাথে প্রধানমন্ত্রীর চুবানির কোনো সম্পর্ক নেই’
গ্রামীণ টেলিকমের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘চুক্তি অনুযায়ী এরই মধ্যে টাকা দেয়া শুরু হয়েছে৷ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সব টাকা দিয়ে দেয়া হবে৷ তবে টাকা দেয়া হচ্ছে কর্মচারী ইউনিয়নের মাধ্যমে৷”
তিনি বলেন, ‘‘গ্রামীণ টেলিকমের নিজস্ব ব্যবসা খুব বেশি নাই৷ কোম্পানি চাচিছলো সেই ব্যবসার শতকরা পাঁচ ভাগ লভ্যাংশ কর্মচারীদের দিতে৷ কিন্তু তারা গ্রামীণ ফোন থেকে পাওয়া লভ্যাংশও দাবি করে আসছিল৷ শেষ পর্যন্ত গ্রামীণ টেলিকম সেটাও দিতে রাজি হয়ে চুক্তি করায় তারা মামলা প্রত্যাহার করেছে৷ তবে কর্মচারীরা ওই টাকার সুদ থেকে একটি অংশ ছাড় দিয়েছে৷ আর কর্মচারীরা এই টাকা পাওয়ার পর কোম্পানি ছেড়ে চলে যাবে বলে চুক্তি করেছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘এর ফলে কর্মচারীরা প্রত্যেকে দেড় থেকে তিন কোটি টাকা করে পাচ্ছেন৷ তবে গ্রামীণ টেলিকমের নিজস্ব যে ব্যবসা আছে, সেগুলো আর থাকবে না৷ কর্তৃপক্ষ কোম্পানিটি আলাদা ফর্মে নিয়ে যাবেন, নতুন পরিচিতি তৈরি হবে৷ ফলে ওই কর্মচারীরাও আর চাকরিতে থাকছেন না৷”
তার কথা, ‘‘এর সাথে প্রধানমন্ত্রীর নাকানি চুবানির কোনো সম্পর্ক নেই৷ এই বিরোধটি ছিল গ্রামীণ টেলিকমের এখন সাবেক হয়ে যাওয়া কর্মচারী এবং গ্রামীন টেলিকমের মধ্যে৷ প্রফেসর ইউনূসের সাথে কোনো বিরোধ এটা নয়৷ আর কর্মচারীদের সাথে সমঝোতা হয় এক মাস আগে৷”
তবে এনিয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করেও কর্মচারী ইউনিয়নের দায়িত্বশীল কোনো নেতাকে পাওয়া যায়নি৷
গ্রামীণ টেলিকমের বিবৃতি
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘‘গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় সৃষ্ট একটি নট ফর প্রফিট কোম্পানি৷ এই আইনে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানে কোনো মালিক থাকে না৷ যেহেতু শেয়ারহোল্ডার থাকে না, সেজন্য এর মুনাফাও বন্টনযোগ্য নয়৷ প্রফেসর ইউনূস এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মালিক হবার কোনো সুযোগ নেই৷ এই কোম্পানী ও অন্য কোনো কোম্পানী থেকে তিনি কোনো বেতনও নেন না৷”
প্রফেসর ইউনূস এ পর্যন্ত বহুবার বলেছেন যে, বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের কোনো কোম্পানিতে তার কোনো শেয়ার বা মালিকানা নেই৷