রমজানে মুসলমানদের যত ঐতিহাসিক বিজয়

ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায় হজরত মুহাম্মদ (সা.), সাহাবি এবং মুসলিমরা রমজানে আত্মিক উন্নতির পাশাপাশি জাগতিক দায়িত্ব পালনে তৎপর ছিলেন। শিরক ও কুফরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন।

সার-সংক্ষেপে এমন কিছু বিজয়গাঁথা যুদ্ধের বর্ণনা তুলে ধরা হলো-

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ হলো বদর যুদ্ধ। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মদিনার অদূরে বদর প্রান্তর অবস্থিত।

বদর একটি কূপের নাম। বদর প্রান্তরে যুদ্ধ হওয়ার কারণে এটি বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। তবে কোরআনে এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফোরকান’ তথা সত্য-মিথ্যা ও হক-বাতিলের পার্থক্যকারী দিন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

পটভূমি: নবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় এসে বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেন এবং ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করেন। এতে কুরাইশদের গাত্রদাহ হয়। এ ছাড়া সিরিয়ার ব্যবসার পথে মুসলিমদের অবস্থান তাদের অনিরাপত্তার শঙ্কায় ফেলে। তাই উদীয়মান ইসলামি রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে অর্থের জোগান ও যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করতে মক্কার একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া যায়। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এই কাফেলায় ছিল এক হাজার মালবাহী উট এবং চল্লিশজন সশস্ত্র রক্ষী বাহিনী। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে এই কাফেলায় অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। ব্যবসা শেষে তারা মদিনার পথ ধরে মক্কায় ফিরছিল।

এই সংবাদ পেয়ে নবী (সা.) কাফেলার পথ রোধ করবার জন্য বের হন। কেননা এ কাফেলায় কমপক্ষে ৫০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার সম্পদ ছিল। যা মক্কায় পৌঁছাতে পারলে সবই মুসলিমদের বিপক্ষে ব্যয় হতো। কিন্তু আবু সুফিয়ান বিষয়টি টের পেয়ে ভিন্ন পথ ধরে এবং একজন উটারোহীকে দ্রুত মক্কায় পাঠিয়ে দেয়। মক্কার কুরাইশরা এ খবর পেয়ে আবু জাহলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা নিয়ে মদিনা অভিমুখে বের হয়। এই বাহিনীতে ১০০টি ঘোড়া এবং ১৭০টি উট ছিল। অন্যদিকে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। আর তাদের সঙ্গে ছিল দুটি ঘোড়া ও ৭০টি উট।

মক্কার কুরাইশরা বদর প্রান্তের উঁচু টিলাতে অবস্থান নেয়। মুসলিমরা বদর কূপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঢালু প্রান্তে শিবির স্থাপন করে। যুদ্ধের পূর্বরাতে বৃষ্টি হলে মুসলিমরা চৌবাচ্চা তৈরি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে এবং অন্যান্য জলাশয়ের পথ আটকে দেয়। ফলে কুরাইশরা পানির সংকটে পড়ে। কুরাইশ নেতা আসওয়াদ মাখজুমি আল্লাহর কসম করে বলে, আমি ওদের চৌবাচ্চা থেকে পানি সংগ্রহ করেই ছাড়ব। নতুবা তা ধ্বংস করবো। প্রয়োজনে এর জন্য জীবন দেবো। সে সামনে এগিয়ে এলে হামজা (রা.) তাকে হত্যা করেন। ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

আরবের প্রাচীন যুদ্ধরীতি অনুযায়ী মল্লযুদ্ধের জন্য কুরাইশদের পক্ষে উতবা, শায়বা এবং ওয়ালিদ বের হয়ে আসে। মুসলিমদের পক্ষ থেকে এগিয়ে আসেন তিনজন আনসার সাহাবি আউফ, মুয়াউয়িজ ও আবদুল্লাহ (রা.)। কুরাইশরা বললো, আমরা স্বজাতিদের সঙ্গে লড়তে চাই। তখন রাসুল (সা.) উবায়দা, হামজা ও আলী (রা.)-কে মোকাবিলার নির্দেশ দেন। তারা তিনজনই নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেন। এরপর সম্মিলিত যুদ্ধ শুরু হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। নবী (সা.) একটি টিলার ওপর থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। আল্লাহ তাআলা তিন থেকে পাঁচ হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করেন। তাদের আক্রমণে কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পিছু হটতে থাকে। আবু জাহলের মতো বড় বড় কুরাইশ নেতাসহ ৭০ জন কাফের নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দি হয়। আর ১৪ জন সাহাবি শহীদ হন। আল্লাহ তাআলা শিরক, মিথ্যা ও অনাচারের বিরুদ্ধে তাওহিদ, সত্য ও ইনফাসের ঝান্ডা উঁচু করেন।

এই যুদ্ধ বিজয়ের কারণে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে একত্ববাদের উত্থান হয়। আরব ভূখণ্ডে মুসলিমদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তাদের সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়। অন্যান্য গোত্রের ওপর কুরাইশদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাস পায়। মুসলিমরা তাদের আস্থাভাজনে পরিণত হয়। সর্বোপরি এই জয়ের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য, ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি লাভ হয়।

মক্কা বিজয় একটি রক্তপাতহীন বিজয়। এটি নবী (সা.)-এর দূরদর্শিতার ফসল। মক্কা নগরীতে একত্ববাদের প্রতীক কাবাঘর অবস্থিত। পৃথিবীর সূচনা থেকে যুগে যুগে একত্ববাদের চর্চা হয়েছে এই ঘরে। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা আল্লাহর ঘরে মূর্তিপূজা ও শিরকের আখড়া বানিয়ে রেখেছিল। হিজরতের পর থেকে রাসুল (সা.) সেই একত্ববাদের তীর্থঘরে বিজয়ী বেশে ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। ৮ম হিজরির ১৮ মতান্তরে ২০ রমজানে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সে অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে। তিনি বিজয়ী অথচ বিনয়ী হয়ে এই পবিত্র নগরে প্রবেশ করেন। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ব, ক্ষমা, শান্তি এবং ভালোবাসা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিজয়ানন্দ উদ্‌যাপনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

৬ষ্ঠ হিজরিতে রাসুল (সা.) ওমরার উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে বের হন। হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে মক্কার কুরাইশরা তাঁর পথ রোধ করে। দুই পক্ষের মধ্যে ১০ বছরের জন্য সন্ধি হয়। সন্ধিতে যেকোনো পক্ষের সঙ্গে অন্য গোত্রের মৈত্রীচুক্তির অনুমোদন থাকে। সে মতে বনু বকর কুরাইশদের সঙ্গে আর বনু খোজায়া মুসলিমদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে। কুরাইশরা এই সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে। বনু খোজায়ার লোকেরা হারাম শরিফে আশ্রয় নিলেও তাদের ওপর আক্রমণ করে। এতে তাদের প্রচুর লোক নিহত হয়। এই ঘটনার পর বনু খোজায়ার নেতা আমর ইবনে সালিম রাসুল (সা.)-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তিনি তাদের সাহায্য করার আশ্বাস দেন। তিনি মক্কার কুরাইশদের কাছে এই মর্মে একটি বার্তা প্রেরণ করেন—১. খোজায়া গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করতে হবে, ২. অথবা বনু বকরের সঙ্গে কুরাইশের মৈত্রীচুক্তি বাতিল করতে হবে, ৩. অথবা হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল বলে ঘোষণা করতে হবে। কুরাইশরা তৃতীয় শর্ত গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের ভুল সিদ্ধান্ত বুঝতে পেরে সন্ধি নবায়নের জন্য আবু সুফিয়ানকে মদিনায় প্রেরণ করে। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়ে মক্কায় ফিরে যায়।

মক্কা অভিমুখে যাত্রা:

অষ্টম হিজরির ১০ রমজানে সম্পূর্ণ গোপনে মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু হয়। এই অভিযানে বিভিন্ন মিত্র গোত্রের লোকেরা মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়। এভাবে মোট সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার। তারা ১২ দিন পথচলার পর মারউজ জাহরান নামক গিরি-উপত্যকায় পৌঁছে শিবির স্থাপন করে।

মক্কা নগরের চারপাশে প্রায় এক হাজার ফিট উঁচু পাহাড়। চারকোণে ৪০টি প্রবেশ পথ। এ জন্য মহানবী (সা.) সৈন্যদের চার ভাগে বিভক্ত করেন। একটি দল ছাড়া বাকি তিনটি দল বিনা রক্তপাতে মক্কায় প্রবেশ করে। আবু সুফিয়ান খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর দলকে আটকে দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ হয়। এতে ১২ জন কুরাইশ নিহত হয় এবং দুজন মুসলিম শহীদ হন। মহানবী (সা.) মক্কায় প্রবেশ করে কাবাঘর তওয়াফ করলেন। তখন কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল।

রাসুল (সা.) হাতের ছড়ি দ্বারা মূর্তিগুলো নিচে ফেললেন। দেয়ালের ছবিগুলো মোছার নির্দেশ দিলেন। তখন তিনি বলছিলেন, সত্য সমাগত। মিথ্যা দূরীভূত। এরপর তিনি মক্কায় ১৯ দিন অবস্থান করলেন। ৯ জন ছাড়া সব মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। মহানবী (সা.) মক্কায় প্রবেশ করে লোকদের বলেন, হে কুরাইশরা! তোমাদের সঙ্গে আমার কেমন আচরণ করা উচিত বলে মনে করো? তারা বললো, দয়া ও করুণা হে আল্লাহর নবী! আমরা আপনার কাছ থেকে ভালো ছাড়া কিছুই আশা করি না। এরপর তিনি ঘোষণা করলেন, আমি তোমাদের ঠিক তাই বলব যা ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের বলেছিলেন। আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমরা যেতে পারো কারণ তোমরা মুক্ত।

জয়ের প্রভাব: মক্কা বিজয়ের পর পবিত্র কাবাঘর শিরক ও মূর্তির অবিচার থেকে মুক্ত হয়। আরবে ইসলামের অগ্রযাত্রা অপরিহার্য হয়ে ওঠে এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপ মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং সমীহ করতে শুরু করে।

নাখলা নামক জায়গার মূর্তি অপসারণ

রাসুল (সা.) অষ্টম হিজরির ২৫ রমজান হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন নাখলা নামক জায়গার একটি বৃহদাকার মূর্তি অপসারণের জন্য। কাফিররা এর পূজা করত, যার নাম ছিল উজ্জা। খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) নিজ হাতে ওই মূর্তি অপসারণ করেন। এরপর তিনি বলেন, আর কখনো এখানে উজজার উপাসনা হবে না। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৩১৬)

নবম হিজরির রমজান মাসে তায়েফের সাফিফ গোত্র স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং তারা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের উপাস্য ‘লাত’ নামক মূর্তি অপসারণ করে। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৫/৩১৬)

SHARE THIS ARTICLE