শান্তির জন্য নোবেল ২০২১: মারিয়া রেসা এবং দিমিত্রি মুরাটভ

Nobel Peace Prize awarded to Filipino and Russian journalists | Financial  Timesডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রচেষ্টার জন্য মারিয়া রেসা এবং দিমিত্রি মুরাটভ নামের দুইজন সাংবাদিককে যৌথভাবে ২০২১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে গত ৮ই অক্টোবর এক ঘোষণায় জানিয়েছে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। আমরা জানি মত প্রকাশের স্বাধীনতা হচ্ছে গণতন্ত্র এবং দেশে দেশে স্থায়ী শান্তির পূর্বশর্ত। মারিয়া রেসা তার মাতৃভূমি ফিলিপাইনে আর দিমিত্রী মুরাটভ তার জন্মভূমি রাশিয়ায় মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সাহসী লড়াইয়ের জন্য শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন। একই সময়ে, তারা সেই সমস্ত সাংবাদিকদের প্রতিনিধি যারা এই আদর্শের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এমন একটি বিশ্বে যেখানে গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি।

Who will be awarded Nobel Peace Prize 2021?মারিয়া রেসা তার জন্মভূমি ফিলিপাইনে ক্ষমতার অপব্যবহার, সহিংসতা এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ প্রকাশ করতে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যবহার করেন, যেখানে তার ভূমিকা ছিল ভয় ভীতির উর্ধে। মারিয়া রেসা ২০১২ সালে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য "র‍্যাপলার" নামে একটি ডিজিটাল মিডিয়া কোম্পানি সহ-প্রতিষ্ঠা করেন। "র‍্যাপলার" ফিলিপাইনে রড্রিগো ডুটার্টো সরকারের বিতর্কিত, মাদক বিরোধী হত্যা অভিযানের উপর সমালোচনামূলক নিবদ্ধ প্রকাশ করেছে। এই অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি যে এটি দেশের নিজস্ব জনগনের বিরুদ্ধে চালানো যুদ্ধের মতো হয়ে গিয়েছে। মারিয়া রেসা এবং তার সংগঠন "র‍্যাপলার" প্রকাশ করেছেন কীভাবে ভুয়া খবর ছড়াতে, বিরোধীদের হয়রানি করতে এবং পাবলিক ডিসকোর্স ম্যানিপুলেট করতে সামাজিক মেডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
Very happy': Duterte congratulates Maria Ressa on Nobel Prize | Freedom of  the Press News | Al Jazeera
মারিয়া সিএনএন-এর জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রধান অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় দুই দশক। ২০১৮ সালে জাল সংবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সাংবাদিকদের একজন হিসেবে টাইম'স পার্সন অফ দ্য ইয়ার হিসাবে ঘোষিত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী ফিলিপাইনের ব্যবসায়ী উইলফ্রেডো কেং সম্পর্কিত একটি সংবাদ র‍্যাপলার কর্তৃক প্রকাশিত হলে, মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে কর্তৃপক্ষ মানহানির অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৫ই জুন, ২০২০ -এ, ম্যানিলার একটি আদালত বিতর্কিত সাইবার অপরাধ আইনের অধীনে সাইবারলিবেল হিসেবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং সাংবাদিক সমাজ এই সাজাকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ হিসাবে নিন্দা করেছে। যেহেতু মারিয়া ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তের একজন স্পষ্টবাদী সমালোচক, তাই তার গ্রেপ্তার এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়াকে বিরোধী দল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ হিসেবে দেখেছেন। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার দ্বারা পরিচালিত তথ্য ও গণতন্ত্র কমিশনের ২৫ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে রেসা একজন।

দিমিত্রি আন্দ্রেয়েভিচ মুরাটভ কয়েক দশক ধরে রাশিয়ায় ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে বাকস্বাধীনতা সমুন্নত করেছেন। ১৯৯৩  সালে, "নোভাজা গেজেটা" নামক স্বাধীন একটি সংবাদপত্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন মুরাটভ। ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি মোট ২৪ বছর ধরে ঐ সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। "নোভাজা গেজেটা" রাশিয়ার ক্ষমতার প্রতি সমালোচনামূলক মনোভাব নিয়ে মতামত প্রকাশ করে আজ রাশিয়ার সবচেয়ে স্বাধীন সংবাদপত্র। সত্য-ভিত্তিক সাংবাদিকতা এবং পেশাদার সততা এই পত্রিকা "নোভাজা গেজেটাকে" রাশিয়ান সমাজের নিন্দাযোগ্য দিকগুলির তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে তৈরি করেছে যা অন্য মিডিয়া দ্বারা খুব কমই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৯৩ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে, নোভাজা গেজেটা রাশিয়ার অভ্যন্তরে দুর্নীতি, পুলিশি সহিংসতা, বেআইনি গ্রেপ্তার, নির্বাচনী জালিয়াতি এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে এবং বাইরে রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর ব্যবহার থেকে শুরু করে "ট্রল কারখানা" বিষয়ক সমালোচনামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।
Who Is Dmitry Muratov, Nobel Peace Prize Winner? | Time
নোভাজা গেজেটার বিরোধীরা হয়রানি, হুমকি, সহিংসতা এবং হত্যার মাধ্যমে এই সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। সংবাদপত্রটি শুরু হওয়ার পর থেকে আজ অবধি এই পত্রিকার ছয়জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে আনা পলিটকভস্কাজা নামক সাংবাদিকও আছেন যিনি চেচনিয়ায় যুদ্ধের উপর প্রকাশমূলক নিবন্ধ লিখেছিলেন। হত্যা এবং হুমকি সত্ত্বেও প্রধান সম্পাদক মুরাটভ সংবাদপত্রের স্বাধীন নীতি পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেছেন। সাংবাদিকতার পেশাগত ও নৈতিক মানদণ্ড মেনে চলা পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে লেখার অধিকারকে ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করেছেন। মুক্ত, স্বাধীন এবং সত্য-ভিত্তিক সাংবাদিকতা ক্ষমতার অপব্যবহার, মিথ্যা এবং যুদ্ধের প্রচার থেকে রক্ষা করে। 

মত প্রকাশ এবং তথ্যের স্বাধীনতা একটি সমাজের জনসাধারনের সচেতনতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। এই অধিকারগুলি গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত এবং যে কোন দেশ এবং জাতিকে যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে রক্ষা করে। মারিয়া রেসা এবং দিমিত্রি মুরাটভকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের উদ্দেশ্য এই মৌলিক অধিকারগুলি রক্ষা এবং রক্ষা করার গুরুত্বকে বোঝানো, এই কথা নোবেল কমিটি তাদের ঘোষণায় উল্লেখ করেছে। নোবেল কিমিটি আরও বলেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যতীত, বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, নিরস্ত্রীকরণ এবং একটি উন্নত বিশ্ব ব্যবস্থা সফলভাবে প্রচার করা কঠিন হবে। এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের পুরস্কার তাই আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছার বিধানে দৃঢ়ভাবে নোঙ্গর করা হয়েছে।" আগামী ১০ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে এই দুই সাংবাদিককে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হবে নরওয়ের রাজধানী অসলো নগরীতে। 

সাংবাদিকদ্বয়ের অবদান নিঃসন্দেহে গুরুত্ত্বপূর্ন। ফিলিপিনের দুতার্তো সরকারের দমন পীড়ন সম্পর্কে আমরা সম্যক অবগত। রাশিয়ায় পুতিন সরকারের নীতি সম্পর্কে বিশ্ববাসী অবগত আছেন। মারিয়া রেসা এবং দিমিত্রি মুরাটোভ আদর্শ সাংবাদিক  হিসাবে বিশ্বে স্থান করে নিয়েছেন বিশেষ করে নোবেল কমিটি এই দুই জনকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বে তাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। আমরা তাদের দুইজনকে অভিনন্দন জানাই। এতে করে সারা বিশ্বের যে সকল দেশে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা নেই কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত সেই সকল দেশের সাংবাদিকরা বিপদ সংকুল পরিবেশে কাজ করতে অনুপ্রাণিত হবেন। দেশে দেশে যে সকল সরকার এই মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করছেন, দমন, নিপীড়ন চালাচ্ছেন এবং যেসব দেশে গণতন্ত্র নিপীড়িত সেই সকল দেশের নেতৃবৃন্দ তাদের চিন্তা ভাবনাকে পরিবর্তন করবেন এটা নোবেল কমিটির সাথে আমরাও আশা করি। যদিও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সাথে এই কার্য্যক্রমের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ নয় পরোক্ষ, তাই সাংবাদিকতায় কিংবা সাহসিকতায় নোবেল পুরষ্কার দেওয়াটা আরও যুক্তিযুক্ত হতে পারত। 

তথ্যসূত্রঃ নোবেল প্রাইজ.অর্গ, উইকিপেডিয়া, আর টি ই, ওয়াশিংটনপোস্ট
SHARE THIS ARTICLE