ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ সাম্প্রতিক সময়ে আয়ারল্যান্ডে জলবায়ু পরিবর্তন একটি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল আমাদের গ্রিন হাউজ নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনা।আয়ারল্যান্ড ইতিমধ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ গ্যাস নির্গমন বন্ধ করা হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে আয়ারল্যান্ডের উচ্চ পর্য্যায়ের সরকারি বিশেষজ্ঞ কমিটি আগামী এক দশকের মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন ৫০% কমিয়ে আনার কার্য্যক্রম প্রকাশ করেছে। সরকার আগামী চার মাসের মধ্যে দুটি পাঁচ বছরের কার্বন বাজেট আইনত বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা করছে। প্রথম পাঁচ বছরের বাজেটে ২০১৮ সালে নির্গমনের তুলনায় বছরে ৪.৮% গ্যাস নির্গমন কমাতে হবে। ২০২৫ সালের পর দ্বিতীয় বাজেট শুরু হবে, যাতে বার্ষিক ৮.৪% কমানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার একটি সমাধান হল দেশের বার্ষিক কার্বন ট্যাক্স বৃদ্ধি — গ্যাস, তেল এবং কয়লার মতো জ্বালানির কার্বন সামগ্রীর উপর শুল্ক ধার্য্য করা। এই লক্ষ্যে ২০২২ সালের বাজেটে কার্বনের উপর লেভিতে অতিরিক্ত ৭.৫০ ইউরো যোগ করেছে, যার ফলে প্রতি টন কার্বনের জন্য ৪১ ইউরো লেভি প্রদান করতে হবে। কার্বন ট্যাক্স হল একটি শুল্ক যা সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের উপর ধার্য করা হয়। কেরোসিন, চিহ্নিত গ্যাস তেল, তরল পেট্রোলিয়াম, জ্বালানী তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কঠিন জ্বালানীর জন্য এই ট্যাক্স প্রযোজ্য। মূলত, যে কোনো জ্বালানি যা পোড়ালে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয় তার জন্যই এই ট্যাক্স প্রদান করতে হবে। অতি সাম্প্রতিক যে ট্যাক্স বৃদ্ধি হয়েছে তার ফলে প্রতি ৬০ লিটার ট্যাঙ্কে পেট্রোল ভরার জন্য ১.২৮ ইউরো বেশী আর ৬০ লিটার ডিজেল ভরার জন্য ১.৪৮ ইউরো বেশী প্রদান করতে হবে। বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ৫৪% আসে শক্তি (এনার্জি) থেকে এবং ৫% এর কম আসে শিল্প থেকে। এক তৃতীয়াংশের কাছাকাছি গ্রিন হাউজ গ্যাস খামার (ফার্ম) থেকে উৎপন্ন হয় - ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের গড় ১১% উৎপাদনের তুলনায় আয়ারল্যান্ডে তিনগুণেরও বেশি গ্রীনহাইউজ গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি বলছে, এই লক্ষ্য পূরণের জন্য, ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ পেট্রোল এবং ডিজেল গাড়ি বদলে ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রতিস্থাপন করতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে কৃষি এবং খাদ্য উন্নয়ন সংস্থার (টিগাসকের) দ্বারা প্রস্তাবিত পশুসম্পদের সংখ্যা হ্রাস না করে কৃষি থেকে গ্যাস নির্গমনের উচ্চাভিলাষী পূর্বাভাস যথেষ্ট হবেনা। সংস্থাটি বলছে, কৃষি দূষণের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ কমাতে হলে অন্যূন ২ লক্ষ দুগ্ধ জাত গরু কমাতে হবে। এখন, আয়ারল্যান্ডে প্রস্তাবিত এই নতুন জলবায়ু পরিবর্তন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারনের ফলে পরিবার এবং সমাজে এর প্রভাব কি হবে তা এই মুহূর্তে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা কঠিন- তবে এই প্রভাব বিশাল হবে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়- আমাদের মধ্যে অর্ধেক মানুষের গাড়ি বদলে বৈদ্যুতিক গাড়ি নিতে হবে, বাড়ি গরম রাখার জন্য যারা এখনো তেল ব্যাবহার করছেন তা সম্পুর্ন বন্ধ করে দিতে হবে এবং যেসব বিভাগে জনসাধারণ কাজ করে থাকেন যেমন খামার এবং খাবার দাবারের বিভাগে কার্বন ট্যাক্স বাড়তে থাকবে এটা বলাই বাহুল্য। নীচে আমি কিছু পরিবর্তন তুলে ধরার চেষ্টা করলাম; ১। আবাসিক ঘর: এখানে মূল লক্ষ্য হল ঘর গরম রাখার জন্য কম শক্তি ব্যবহার করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করা থেকে দূরে সরে যাওয়া - বিশেষ করে তেলের ব্যাবহার বন্ধ করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ লক্ষ বাড়িকে গরম রাখার পদ্ধতি পুরোটাই বদলে ফেলতে হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে, বাড়ির মালিকদেরকে বয়লার বদলে হিট পাম্প ব্যাবহারে উৎসাহিত করা হবে। সোলার ইলেক্ট্রিসিটি ব্যাবহার করতে উৎসাহিত করা হবে। ২। গাড়ি: বলা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫ লক্ষ বৈদ্যুতিক গাড়ি রাস্তায় চলাচল করতে হবে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ন্যুন্যতম ৯ লক্ষ বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি করতে হবে এবং সকল নূতন গাড়ি বৈদ্যুতিক কেনার প্রয়োজন হবে। শুধু তাই নয় ৮-৯ লক্ষ পেট্রোল এবং ডিজেল গাড়ি স্ক্র্যাপেজ প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে। একই সাথে গনপরিবহনে বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। ৩। খামার এবং খাদ্য: কৃষি এবং খাদ্য হলো কাজের মূল ক্ষেত্র। কৃষক এবং অন্য যারা এই খাতে কাজ করছেন তাদের উপর এর প্রভাব হবে বৃহৎ। কৃষি এবং খাদ্য থেকে উৎপাদন ৭-১৯% হ্রাস পেতে পারে। সরকারের লক্ষ্য নির্ধারনের উপর নির্ভর করবে কতটুকু দুগ্ধ এবং গরুর পরিমাণ হ্রাস হবে। ৪। চাকুরি: চাকরির ক্ষেত্রে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকের প্রভাব পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।। কৃষি এবং খাদ্য খাটে যদি ২০% গ্যাস নির্গমন হ্রাস লক্ষ্যমাত্রা করা হয় তাহলে ৬০০০- ১৩,০০০ মানুষ চাকুরী হারাতে পারে আবার যদি ৪০% হ্রাস করা হয় তাহলে ২১,০০০-৪৫,০০০ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে। ইতিবাচক দিক হলো ঘরবাড়িতে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা পুনরুদ্ধার করতে নূতন ৪০,০০০ কর্মসংস্থান হতে পারে আরও ৩৩,০০০ হাজার কর্ম সংস্থান হতে পারে যদি এই উপকরণগুলি আয়ারল্যান্ডে তৈরি করা হয়, সেই সাথে বায়ু শক্তির অবকাঠামো উন্নয়নে আরও কয়েক হাজার কর্মসংস্থান হতে পারে বলে আবহওয়া পরিবর্তন উপদেষ্টা পরিষদ অভিমত দিয়েছে। ৫। কর এবং ব্যয়: প্রতি বছর ৫০০ কোটি ইউরো বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে অনুমান করেছে উপদেষ্টা কাউন্সিল। এই বিনিয়োগ মূলত শক্তি (এনার্জি) খাতে এবং তার অধিকাংশই আসতে হবে রাষ্ট্রীয় খাত থেকে। আয়ারল্যান্ডের জলবায়ু মন্ত্রী ইমন রায়ান বলেছেন এই গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনা বিরাট চেলেঞ্জিং ব্যাপার এবং আয়ারল্যান্ডে মানুষের জীবন যাত্রায় মৌলিক পরিবর্তন আসবে। সারসংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে প্রতিটি নাগরিককে সকল ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ট্যাক্স গুনতে হবে, পেট্রোল, ডিজেলের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে, গাড়িগুলো দ্রুত বদলে ফেলে বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনতে হবে, বাসাবাড়িতে গ্যাসের ব্যাবহার বন্ধ করে বিদ্যুতের উপর নির্ভর করতে হবে। সার্বিকভাবে জীবন যাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাবে কিন্তু আয় বৃদ্ধির কোন পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে বলে আমা দের নজরে আসেনি।
সূত্রঃ আইরিশ টাইমস, জার্নাল, আর টি ই, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, মিরর, সান