কল্যাণী সেনঃ এ বিষয়ের উপর বিতর্ক হলে হাজারো মতামত আসবে। একজন শিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে আমি জানি, খারাপের পক্ষেই আসবে সর্বোচ্চ মতামত। আগে আমিও অনেকটা তা-ই মনে করতাম।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে পড়ালেখার জন্য অনেকটা বাধ্য হয়েই আমার সন্তানের হাতে ডিভাইস তুলে দিতে হয়েছিল। এখন সেই অভ্যাস থেকে তাদেরকে আর বের করে আনা যাচ্ছে না। ‘তাদের’ শব্দটা ব্যবহার করলাম কারণ আমার মতো অনেকেই হয়তো ভুক্তভোগী।
একেক সময় মনে হতো রান্না করতে যাওয়ার সময়ও মোবাইলটা গলায় ঝুলিয়ে রাখি। অনেকে হয়তো বলবেন মোবাইলে পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখতে। তাহলে শিশু-কিশোররা ফোন ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু সত্যিই কি এটা কোন সহজ সমাধান?
আজকাল প্যারেন্টিং বিষয়টাও পাল্টে গেছে। ছোটবেলায় আমরা কথা না শুনলে মার খেয়েছি। দ্বিতীয়বার মার খাওয়ার ভয়ে সেই কাজ করা থেকে বিরত থেকেছি। কিন্তু এখন বাচ্চাদের শুধু মুখে শাসন করা হয়। বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। তার ওপর মহামারীর সময়ে শিশুরা একেবারে গৃহবন্দি। চব্বিশ ঘণ্টাই তারা মায়ের সঙ্গে থাকে।
যার ফলে মায়ের শাসনকে এখন তারা আর ভয় পায় না। ধমক দিয়ে বা বুঝিয়ে কোনভাবেই তাদের মোবাইল বা ট্যাব থেকে দূরে রাখা যায় না। এ সমস্যা আমার একার নয়, যাদের বাড়িতে কিশোর বয়সী ছেলেমেয়ে আছে তারা সবাই কম-বেশি এ পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন।
পেশায় আমি একজন শিক্ষক। অন্যদিকে সদ্য কৈশোরে পা রাখতে যাওয়া এক মেয়ের মা। শিক্ষক এবং অভিভাবক এ দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে গিয়ে আমি শিশুদের মানসিক বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেছি। কেন তারা ডিভাইসে আসক্ত হচ্ছে এবং এ আসক্তির সবটাই নেতিবাচক কিনা সে বিষয়ে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেছি।
আমি যখন আমার মেয়ের বয়সী ছিলাম তখন আমরা রোজ বিকেলে খেলতে যেতাম। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে আমার শৈশব কেটেছে কলোনিতে। বিকেল হলেই প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনের প্রাঙ্গন মুখরিত থাকতো ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে। আসরের আজান মানেই খেলার সময় শুরু আর মাগরিবের আজান মানে সময় শেষ, এবার বাড়ি যাও।
আমাদের বাবা-মায়েরা কখনো ভয় পেতো না আমাদের খেলতে পাঠিয়ে। কখনো পাহারাও দিত না। আমরা ঠিক সময়মতো বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু আমার মেয়েটিকে আমি সিঁড়িতে খেলতে দিতেও ভয় পাই। আমার পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না রোজ ওকে ছাদে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। তাহলে সে কিভাবে সময় কাটাবে?
তখনই সে ডিভাইস চায়। আমিও স্বাভাবিকভাবে দিতে অস্বীকার করি। তখন সে তুলনা করে আমার ছেলেবেলার সঙ্গে। আমার মুখেই সে আমার ছেলেবেলার গল্প শুনেছে। আমি তখন খুব অসহায় বোধ করি। উত্তর দিতে পারি না।
আমাদের সময় টিভিতে একটাই চ্যানেল ছিল, বিটিভি। রাত আটটার খবরের পর যে অনুষ্ঠানই দেখাতো আমরা পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে সেটা দেখতাম। আজ হাজারো চ্যানেলের ভিড়ে একেকজন একেক অনুষ্ঠান দেখতে চায়। একটা নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান দেখা খুব কম বাড়িতেই হয়। শিশুরা এখানেও বাধা পায়। কার্টুন দেখতে বসলে সেখানেও বিপত্তি, বিদেশি ভাষায় আসক্ত হওয়ার আশঙ্কা। তাহলে সত্যিই তারা করবে কী?
ছোটবেলায় বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আমরা নানাবাড়ি দাদাবাড়ি বেড়াতে যেতাম। এক বা দুই সপ্তাহ থাকতাম। কাজিনদের সঙ্গে দেখা হতো। গল্প হতো। এখন অনেকেরই দাদাবাড়ি নানাবাড়ি একই শহরে হওয়ায় এতদিন থাকা হয় না। কাজের ব্যস্ততাও এজন্য দায়ী। আর এখনতো সামাজিক দূরত্ব বাধ্যতামূলক। দূরের আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে আমরাতো ভিডিও কল, অডিও ম্যাসেজ বা টেক্সট ম্যাসেজেই যোগাযোগ করি।
আমার একমাত্র বোন কানাডা প্রবাসী। আমাদের দুই বোনের দুই মেয়ে কিভাবে যোগাযোগ করবে তাদের যদি ডিভাইস ধরতে না দেই? তারা কখনো ম্যাসেজের মাধ্যমে কখনো ভিডিও কলে কথা বলে। খেলেও কখনো কখনো। তাদের মধ্যে সাত সমুদ্র তেরো নদীর দূরত্বটা ঘুচে যায়।
শিশুরা যে মোবাইল ব্যবহার করে শুধু গেম খেলতে চায় তা কিন্তু নয়। তারা অনেক সৃজনশীল কাজও এর সাহায্যে করে। সুযোগ পেলে তারা বিস্ময়কর এমন অনেক কিছু সৃষ্টি করতে পারে যা আমাদের ধারনারও বাইরে। সন্তানের কৃতিত্বে বাবা-মায়েরা সব সময়ই খুশি হন। তারা প্রযুক্তিকে অনেক তাড়াতাড়ি আয়ত্ব করতে পারে।
স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে আমিও অনেক সময় কাজ করতে গিয়ে আটকে গেলে মেয়ের সাহায্য নেই। আমার মেয়ে তার দিদাকেও ধৈর্য ধরে মোবাইলের খুঁটিনাটি শেখায়। আমি খেয়াল করেছি, এতে নিজেকে সে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখেছে। আজকাল বয়স্ক মানুষগুলো খুব অসহায়। বড়রা তাদের সময় দেয় না। ছোটরা অন্তত দেয়।
বিকেলের সূর্যাস্তের সময় আকাশটা খুব সুন্দর দেখায়। কখনো বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর আকাশে রংধনু ওঠে। মেয়ে খুব সুন্দর করে ছবি তুলে এনে দেখায়। মোবাইল যদি তার হাতের নাগালের বাইরে থাকে তাহলে তার এ প্রতিভার খোঁজও আমার অজানা থেকে যেত।
আমার এক ছাত্রী ‘ডিজিটাল আর্ট কম্পিটিশনে’ বিজয়ী হয়েছে দেখে আমি আনন্দিত হয়েছি। ছাত্রীটির মা যদি তাকে ডিভাইস ব্যবহার করতে না দিত তাহলে তার প্রতিভাতো চাপাই পড়ে থাকতো!
শিশুদের মনে অনেক রকম প্রশ্ন থাকে। বড়রা সবসময় তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেয় না। ইচ্ছে করে এমন করে তা নয়, ব্যস্ততাই এজন্য দায়ী। বই পড়ে জানবে? সবার বাসায় সব ধরনের বই থাকেও না। এক্ষেত্রে শিশুটি গুগলে ঢুকে তার কাঙ্ক্ষিত উত্তরটি খুঁজে নিতে পারবে। তার জ্ঞানের স্পৃহা বাড়বে। বইপড়া, ছবি আঁকা, নাচ-গান-আবৃত্তি চর্চা করা, লেখালেখি করা, শিশুরা এসব কাজে ব্যস্ত থাকুক এটা সব বাবা-মাই চান।
শরীরচর্চাটাও শিশুদের জন্য ভীষণ দরকার। সেইসঙ্গে নিয়ন্ত্রিত মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ ব্যবহারের সুযোগ দিলে ইতিবাচক ফলাফল আসবে। তথ্য প্রযুক্তি এখন বাধ্যতামূলক বিষয়। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বিষয়টি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও তা অপরিহার্য।
স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি যাতে কম হয় সেভাবে শিশুদের ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ দেয়াটা খারাপ নয়। এতে তাদের ব্যবহারিক জ্ঞান বাড়বে ছাড়া কমবে না। একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিলে সন্তানও খুশি থাকবে। যেহেতু নিয়ন্ত্রণ অভিভাবকের হাতে থাকবে তাই আপনিও নিশ্চিন্ত থাকবেন। সন্তানের লুকিয়ে মোবাইল ব্যবহারের প্রবনতাটাও কমবে। আপনার বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সে যেন শুধু গেম না খেলে অন্য কোন আনন্দদায়ক কাজ করে সে ব্যাপারে তাকে উৎসাহ দেওয়াটা জরুরি।
আজকাল ক্লাস-পরীক্ষা অনলাইনে হচ্ছে। যেহেতু এ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, কাজেই এটা চলবে। আমরা যদি চাই আমাদের সন্তান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক তাহলে তাকে এটুকু ছাড় দিতেই হবে।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষক, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ