সম্পাদকীয়ঃ শুভ বড়দিন

সম্পাদকীয়ঃ শুভ বড়দিন। আজ ২৫শে ডিসেম্বর ২০২১ সাল। বিশ্বের সকল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের দিন আজ। শত শত বছর ধরে বিশ্বের খ্রীস্টান সম্প্রদায় উৎসবমুখর পরিবেশে এই বড়দিন পালন করে আসছে। দুই হাজার বছর আগে এইদিনে জেরুজালেমের বেথলেহেমে যিশুখ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেন বলে মনে করা হয়। হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায়-অত্যাচার ও পাপাচারে নিমজ্জিত মানুষকে সুপথে আনার জন্যই আবির্ভূত হয়েছিলেন যিশু। তিনি সারাজীবন আর্তমানবতার সেবা, ত্যাগ ও শান্তির আদর্শ প্রচার করেছেন। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সবাইকে শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। শাসকের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষ নিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি শাসকের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন।

বড়দিন খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের বৃহত্তম আনন্দের দিন। খ্রীস্টান সম্প্রদায় ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এই দিনের নানা কর্মসূচীতে যোগ দিয়ে থাকেন। এ কারণে বড়দিন বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি হয়ে উঠেছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির দিন। উৎসব পালনের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ প্রথাগত নিয়ম থাকলেও পৃথিবীর নানা দেশে আঞ্চলিক সংস্কৃতি এই উৎসবকে প্রভাবিত করেছে।

আয়ারল্যান্ডে এই দিন কোভিড মহামারির কারণে বিভিন্ন বিধি নিষেধের আওতায় মধ্যে আজ ঘটা করে পালিত হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে, আয়ারল্যান্ডে ৮ই ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় উৎসব। এই দিনটিকে বলা হয় ফিস্ট অফ ইমাকুলেট কনসেপশন (নিষ্পাপ গর্ভধারনের উৎসব)। আয়ারল্যান্ডে এই  দিনে ঘরে বাইরে আলোকসজ্জা এবং ক্রিসমাস ট্রি স্থাপন করে শুরু হয় অনুষ্ঠানাদি আর এই উৎসব নূতন বছরের ৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত চলে। ইদানীং আবার নভেম্বরের শেষ শুক্রবার “দ্য লেট লেট টয় শো” কে বড়দিনের উৎসবের সূচনা হিসাবে দেখা হয়।

এই সময়ে সবাই একে অপরকে “হ্যাপি ক্রিসমাস” বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে। নভেম্বর মাসের শেষ থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসবের আমেজ। এখানে প্রতিরাতেই চলে সান্ধ্যকালীন ভোজ বিশেষ করে শুক্রবার এবং শনিবার চলে পানাহার। ক্রিসমাসের দিন এবং এর পরের দিন (ক্রিসমাস ইভ) চার্চে উপস্থিত হয়ে সকলেই ধর্মীয় প্রার্থনায় যুক্ত হয়। বছরের অন্যান্যদিন যারা ধর্মীয় আচার পালন করেনা তারাও এই সময়ে চার্চে গিয়ে প্রার্থনায় যুক্ত হতে দেখা যায়। এখানে এই দিনগুলোতে মৃতদের জন্য প্রার্থনা করা হয় গভীরভাবে। কবরস্থান গুলোতে হলি, আইভি, ইউ এবং অন্যান্য সবুজ পাতার পুষ্পস্তবক দিয়ে সাজানো হয়। এখানে সাধারণ বিশ্বাস যে, ২৫শে ডিসেম্বর থেকে ৬ই জানুয়ারি এই সময়ে কেউ মারা গেলে তারা অবিলম্বে স্বর্গে প্রবেশ করার সুযোগ পায়।

এই সময়ে ঘরবাড়ী সাজানো হয় বিভিন্ন ধরনের আলোকসজ্জায় আর ঘরে ঘরে ক্রিস্টমাস ট্রি শোভা পায়। সান্টা ক্লজকে এখানে স্যান্টা নামে অভিহিত করা হয়। স্যানটা শিশুদের জন্য নিয়ে আসেন বিভিন্ন ধরনের উপহার আর এই উপহার সামগ্রী খোলা হয় বড় দিনের সকালে। ঐতিহ্যগতভাবে রূডোলফের (বল্গাহরিন) জন্য গাজরের সাথে, কিমা পাই এবং এক বোতল গিনিস বিয়ার রেখা দেয়া হয়। বেশিরভাগ শপিং সেন্টারে নভেম্বরের শেষের দিকে স্যান্টার গ্রোটো সাজানো হয় যাতে করে ক্রেতারা এবং বাচ্চাদের সাথে দর্শনার্থীরা সান্তাকে দেখতে পারে এবং বড়দিনের জন্য তারা কী চায় তা বলতে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিংবা আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকলেই এই সময় বাড়িতে ফিরে আসেন, মা-বাবাদের পাশে। এই সময় মায়েরা হয়ে পড়েন মধ্যমণি। ঐতিহ্যগতভাবে ক্রিসমাসের আগের দিন মাছ খাওয়ার রেওয়াজ আছে। ক্রিসমাসের দিনের নৈশ ভোজ হচ্ছে বড়দিনের মূল আয়োজন। ঐতিহ্যবাহী ক্রিসমাস ডিনারে সেদ্ধ, মশলাযুক্ত, ভুনা গরুর মাংস, হাঁসের রোস্ট এবং গ্রিলড শুকরের মাংস সহ বিভিন্ন শাকসবজি এবং পোড়া এবং সিদ্ধ আলু ছিল প্রধানতম খাদ্য। ইদানীং কালে গরুড় মাংসের চেয়েও আকর্শনীয় হয়ে উঠেছে টার্কির রান্না। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন যার মধ্যে কেক ও ব্রান্ডীযুক্ত ক্রিসমাস পুডিং অন্যতম। আগে থেকে কেনা হাজার হাজার টিন বিস্কুট পরে খুলে খাওয়া হয় চা কিংবা কফির সাথে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন ধরনের চকলেটের সমারোহ। 

অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও উৎসবের আমেজে পালিত হয় ২৫শে ডিসেম্বর। সান্তাক্লজের উপস্থিতি আমাদের দেশেও দেখা যায়। শিশুদের প্রিয় এই উপহারদাতার নাম বিভিন্ন দেশে বিভিন্নরকম তবে তার আচরণ বিশ্বের সর্বত্র প্রায় একই রকম। তিনি শিশুদের ভালবাসেন এবং বড়দিনের উৎসবের সময় তাদের নানা উপহার দিয়ে আনন্দ দান করেন।

বিশ্বের সর্বত্র বড়দিন উদ্যাপনের আনন্দ যেন মানুষের মধ্যে সত্যিকার মানবতাকে জাগ্রত করে। যিশু যে প্রেম, শান্তি ও সম্প্রীতির বাণী প্রচার করেছেন তার যথার্থ প্রতিফলন যেন সবার জীবনে ঘটে তাহলেই বড়দিনের উৎসব সবার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। এই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদা দেয়ার জন্য বিশ্বের প্রায় সকল দেশই ২৫ ডিসেম্বর সরকারী ছুটির দিন পালন করে আসছে। বাংলাদেশেও ২৫ ডিসেম্বর সরকারী ছুটির দিন। পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতো এ দেশের খ্রীস্টান সম্প্রদায়ও বড়দিনের উৎসব পালন করছেন। দেশের সব গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে এদিন। গির্জাগুলোতে ক্রিসমাস ট্রি, গোশালায় মাতা মেরির কোলে শিশু যিশু এবং শিশুদের স্বপ্ন পূরণের দেবদূত সান্তাক্লজ উপঢৌকন নিয়ে তৈরি থাকবেন। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে বিশেষ খাবারসহ উৎসবের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে।

প্রত্যেক ধর্মেরই মূল বাণী মানবতা। বড়দিন উপলক্ষে যে প্রেম, প্রীতি ও শান্তির বাণী প্রচার করা হয় তার মূলেও রয়েছে মানবতা। কোন ধর্মই এই বোধ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বড়দিন মানুষকে শান্তি, প্রেম ও সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। দিনটি উদ্যাপন উপলক্ষে দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। দেশের সব মানুষ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ায় ব্রতী হবেÑ এই প্রত্যাশা বড়দিনে। সবশেষে প্রার্থনা- ঈশ্বর ও প্রভু যিশু বিশ্বের সকল মানুষের মঙ্গল করুন।

SHARE THIS ARTICLE