আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ শ্রীলংকার সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি করা একটি মামলার রায়ে করোনা আক্রান্ত কিংবা করোনা সন্দেহে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মৃতদেহকে বাধ্যতামূলক পুড়িয়ে ফেলার বিরুদ্ধে করা মামলাকে খারিজ করে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার মুসলিম ও খ্রিস্টান পরিবার যাদের ধর্মীয় প্রথা লঙ্ঘন করে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দাহ করা হয়েছিল তারা সম্প্রতি শ্রীলংকা সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করলে সেটা কোর্ট থেকে খারিজ করে দেয়া হয়।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ শ্রীলংকায় কোভিড-১৯ সংক্রমিত সকল মৃতদেহকে বাধ্যতামূলক দাহ করার নীতি মুসলিম ও খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের জন্য ক্ষোভ এবং আঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম এবং খ্রিষ্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য মৃতদেহ সমাহিত করা অত্যাবশ্যক ।
কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যাদের মৃতদেহ দাহ করা হয়েছিল তাদের বেশিরভাগের হয় কোভিড টেস্ট করা হয়নি, না হয় তাদের পরীক্ষার ফলাফল নিগেটিভ ছিল। শ্রীলঙ্কায় কোভিড-১৯-এ ২৬,৫৫৯ এরও বেশি আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১২৯ জন মারা গেছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ৫০ জনেরও বেশি মুসলিম ধর্মাবলম্বী।
এক মুসলিম ব্যক্তি তাঁর মায়ের মৃতদেহকে ভুলে দাহ করা হয়েছিলো বলে জানান। তিনি জানান, “গত মে মাসে যেদিন আমার মা হাসপাতালে মারা গেলেন, তারা তার মরদেহ দাহ করলেন এবং আমাকে ছাইয়ের একটি পাত্র দিলেন। কিন্তু পরের দিন কর্তৃপক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয় যে আমার মায়ের পরীক্ষা নিগেটিভ এসেছে এবং তাকে দাহ করা ভুল ছিল। প্রতি রাতে আমি ঘুম থেকে উঠে মায়ের ভাগ্যের কথা চিন্তা করি। আমরা গরিব এবং আমাদের কাছে বিচার দাবি করার বা কর্তৃপক্ষের সাথে লড়াই করার উপায় নেই।”
সংবিধানের আওতায় ধর্মের স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার লংঘনের অভিযোগ করে সরকারের বিরুদ্ধে মুসলিম ও খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের ১১টি পরিবার এই দাহ করার বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে নেমেছিল। তবে, এই সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট আপিল শুনানি করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মামলাটি খারিজ করে দিলে তাদের বিচারের চূড়ান্ত আশা ব্যার্থ হয় এবং মৃতদেহ দাহ করার বাধ্যতামূলক ব্যাবস্থা অব্যাহত থাকার পক্ষেই আইনি ব্যাবস্থা দাঁড়িয়ে যায়।
কিছু মুসলিম পরিবার তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহের অধিকার অস্বীকার করা শুরু করেছে কারণ তারা এই দাহ করার সাথে নিজেদের যুক্ত করতে চান না কেননা তারা এই বিষয়টিকে ধর্মীয়ভাবে অমার্জনীয় পাপ হিসেবে দেখছেন। অনেকেই মৃতদেহ দাহ করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত ৪৮,০০০ রুপি (১৯২ ডলার) দিতে অস্বীকার করেছেন যার ফলে মর্গে মুসলিম মৃতদেহ স্তূপীকৃত হচ্ছে।
মোহাম্মদ আশরাফ (৪৯) জানান, “আমার মামা মোহাম্মদ জেফরি (৭৬), ২ রা নভেম্বর করোনভাইরাসে মারা গেলে, তাঁর মৃতদেহ বাধ্যতামূলক কলম্বোর একটি হাসপাতালে আনা হয় এবং কফিনের জন্য অর্থ দাবি করা হয় কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছি কারণ আমি তাদের বলেছিলাম যে লাশ পোড়ানো আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে। আমাদের আইন মেনে চলতে হবে তবে আমরা অংশ নেব, তা না করা হলে আমরা কোন অর্থ প্রদান করব না, এতে আমাদের কোনও অংশ থাকবে না এবং এতে আমার কোন ধরনের সম্পৃক্ততা থাকবে না। ”
মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন যে, মরদেহ পড়িয়ে ফেলার এই নীতিটি শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি গোটবায়া রাজাপাকসের নেতৃত্বে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীলংকা সরকার কর্তৃক ৯% মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর হামলার একটি অংশ। গত এপ্রিলে ইস্টারের সময় গির্জা ও বিলাসবহুল হোটেলগুলিতে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের দ্বারা আত্মঘাতী বোমা হামলায় শ্রীলংকায় ২৬৭ জনের মৃত্যু হলে, মুসলিম বিরোধী কট্টর বৌদ্ধিক অনুভূতির তরঙ্গ রাজপাকসার নির্বাচনী বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিলো।
মানবাধিকারকর্মী শ্রীন সরুর বলেছেন: “এই মহামারী চলাকালীন তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে যেভাবে আচরণ করে আসছে তা স্পষ্ট বর্ণবাদ। সম্প্রদায়টি তাদের বিশ্বাস ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য তাদের নিজের মৃতদেহকে ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। মৃত্যুর মর্যাদাকে অস্বীকার করার বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতাও নেই।”
পৃথিবীতে চীনের পর শ্রীলঙ্কাই একমাত্র দেশ যেখানে কোভিড-১৯ ভাইরাস দ্বারা ভূগর্ভস্থ জলাশয় দূষিত হতে পারে এবং ক্ষতিগ্রস্থদের মৃতদেহ “জৈবিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে … নির্দিষ্ট গোষ্ঠী দ্বারা “ এই দুই অজুহাতে মৃতদেহ বাধ্যতামূলক পুড়িয়ে ফেলার নীতি গ্রহণ করেছে।
তবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশনা জারি করে জানিয়েছে যে মৃতদেহ দাফন জনস্বাস্থ্যের জন্য কোনও বিপদ সৃষ্টি করে না। শ্রীলঙ্কায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী এবং জাতিসংঘের আঞ্চলিক গোষ্ঠী সকলেই শ্রীলঙ্কা সরকারকে চিঠি দিয়ে, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিকে মর্যাদার সাথে এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সংগতি রেখে সম্মানের সাথে সৎকার পরিচালনার দাবী জানিয়েছে।
এই সপ্তাহে, বাধ্যতামূলক মৃতদেহ পোড়ানো দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থদের ন্যায়বিচারের অভাবের নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতিতে ২৪টি মানবাধিকার ও অ্যাডভোকেসি গ্রুপ স্বাক্ষর করেছে। তারা বিবৃতিতে জানিয়েছে “এই পদক্ষেপগুলি একাধিক ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, বিশেষ করে এটি মুসলিমদের জন্য ভয়ানক, কেননা তাদের ধর্মীয় রীতিতে মৃতদের কবর দেয়া বাধ্যতামূলক। সরকার যে পদ্ধতিতে এটি পরিচালনা করছে তাতে তারা অসম্মানিত, লাঞ্ছিত ও হুমকি বোধ করছে।”
তথ্যসূত্রঃ দা গার্ডিয়ান, বি বি সি