সংকটের আবর্তে ইসলামঃ ইমানুয়েল ম্যাক্রন (ভিডিও)

৩রা অক্টোবর ২০২০, আইরিশ বাংলা পোস্ট ডেস্কঃ গতকাল শুক্রবার প্রদত্ত এক টেলিভিশন ভাষণে ফরাসী রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রন, প্রজাতন্ত্র এবং তার মূল্যবোধ রক্ষা, সমতা ও মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন। “ইসলামকে” বিদেশী প্রভাব থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে “ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদের” বিরুদ্ধে একটি আইন করার ঘোষণা করেছেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন।  
“র‍্যাডিক্যাল ইসলামিজম” ও “সন্ত্রাসবাদের” বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পদক্ষেপ হিসেবে গাজর ও কাঠি পদ্ধতির পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্থানীয় কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত আইনী ক্ষমতা দেওয়া হবে, শিক্ষায় – বিশেষতঃ “ইসলামী সংস্কৃতি” ও সভ্যতা -এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা বিশেষ করে আবাসিক ও দারিদ্র বিমোচনে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করা হবে। 
ম্যাক্রন বলেন “আমাদের চ্যালেঞ্জ হ’ল তাদের বিরুদ্ধে, যারা ধর্মের নামে পথচ্যুত; তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা … যারা “ইসলামে বিশ্বাসী” এবং “প্রজাতন্ত্রের পূর্ণ নাগরিক” তাদের রক্ষা করা।”
“বিচ্ছিন্নতাবাদ” ইস্যুটিকে সম্বোধন করে “সাম্প্রদায়িকতা” কিংবা ফ্রান্সে নিজেদের শাসিত সাম্প্রদায়িক অনুশীলনের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে “ফ্রান্সের বৃহত্তর সমাজে মুসলমানদের আরও সংহত করার আহ্বান জানান।” 
তিনি বলেন, “মুসলিমদেরকে জানাতে এসেছি, এই সংগ্রাম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, এই পদক্ষেপগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে নয় বরং মুসলিমদেরকে এই সমাজে ইন্টিগ্রেট করতে সহায়তা করা এবং ফ্রান্সের মুসলমানদের অধিকতর সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যেই সাজানো হয়েছে।“
“যে বিষয়টি অবশ্যই আমাদের কখনই ভাবা উচিত নয়, যা আমি মাঝে মাঝে কিছু লোকের কাছ থেকে শুণছি যে, ‘এই উদ্যোগ ইসলামের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পনা’। এই ধারনা একটি মারাত্নক ভুল, আমাদের লড়াই করতে হবে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে, কারণ যখন প্রজাতন্ত্র তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনা তখন তা প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা করে।“
শুক্রবারের ভাষনে ম্যাক্রন আগামী দিনে গৃহীত পদক্ষেপগুলির একটি বিস্তৃত রূপরেখা প্রদান করে বলেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এই আইন প্রণয়ন করে ডিসেম্বরে উপস্থাপন করা হবে।
পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে, মসজিদগুলিকে অধিকতর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা এবং বিদেশ থেকে আগত ইমামদের ফ্রান্সে প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। তিনি বলেন তার লক্ষ্য হচ্ছে, “বিদেশী প্রভাব থেকে “ফরাসী ইসলাম”কে মুক্ত করা, বিশেষ করে অর্থায়ন”; তিনি বলেন, ফরাসি রাষ্ট্র থেকে তহবিল প্রাপ্ত ইসলামিক সংগঠনগুলিকে একটি “ধর্মনিরপেক্ষ সনদ” স্বাক্ষর করতে হবে।
প্রজাতন্ত্রের আদর্শের বিপরীত ধারণা পোষণকারী সংস্থাগুলি নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হতে পারে এবং ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা এবং গবেষণার জন্য ১ কোটি ইউরো বাজেট ব্যয় করার কথা বলেন।


ম্যাক্রন আরও বলেন, “২০১২ সাল থেকে দেশটি ইসলামী সন্ত্রাসবাদী দ্বারা বারে বারে  আক্রান্ত হয়েছে এবং আমরা এই হুমকির বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমানভাবে শক্তি অর্জন করেছি।” “র‍্যাডিকাল ইসলামিজম” প্রজাতন্ত্রের আইনকে লঙ্ঘন, ভিন্ন মূল্যবোধের প্রচার ………..ভিন্ন ধরনের সমাজ গঠনের” প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক অতীত দেশটিকে কিছু সমস্যার মুখোমুখি করতে সহায়তা করেছে।
“আমরা আমাদের কয়েকটি এলাকাকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি, একই দেশ থেকে আসা এবং একই ধর্মের মানুষকে এক এলাকায় কেন্দ্রীভূত করে দিয়েছি যা “অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত সমস্যা” তৈরি করেছে। 
ম্যাক্রন, “প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি ভবনে প্রজাতন্ত্রের উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে” দেশের শিক্ষা ও বিচার মন্ত্রনালয়ের জন্য অতিরিক্ত তহবিল ঘোষণা করেন । তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থা হলো মূল চাবিকাঠি এবং আগামী বছরের সেপ্টেম্বর থেকে তিন বছর বয়সী শিশুদের স্কুলে পড়াশোনা শুরু করতে হবে,  হোম স্কুলিং সীমাবদ্ধ করা হবে।

তিনি বলেন, আবাসন সহ অন্যান্য সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য আগামী সপ্তাহগুলিতে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, “বিশাল পরিবর্তন করা হবে, আমরা দারিদ্র্যের সাথে আরও দারিদ্র্য যোগ করতে পারি না।” 

“ফ্রান্সের মাটিতে তুরস্কের আইন চলতে পারেনা” 
এদিকে এই ভাষণে ম্যাক্রন আরও বলেন, “সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া কোর্স এবং বিষয়বস্তুগুলিতে ফরাসী রাষ্ট্রের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য ইমাম ও শিক্ষকদের ফ্রান্সে আসার অধিকার সম্বলিত বর্তমান আইন বাতিল করে ভবিষ্যতে ইমাম ও শিক্ষকদের শুধুমাত্র দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আসার সুযোগ রেখে নূতন আইন করা হবে।” 

ম্যাক্রন জানান, আলজেরিয়া, মরক্কো এবং তিউনিসিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশের সাথে ফ্রান্সের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থাকলেও তুরস্ক এর ব্যাতিক্রম ছিল। তুরস্ক এখন আমাদের সাথে চুক্তির পথ অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে বা নাও নিতে পারে, তবে আমি অন্য কোন দেশকে আমাদের প্রজাতন্ত্রের মাটিতে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা পরিচয়-ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতে দেব না।” ম্যাক্রন প্রত্যয় ব্যাক্ত করে বলেন, “ফ্রান্সের মাটিতে তুরস্কের আইন চলতে পারে না। কোনও উপায়েই না।” 
সূত্রঃ এ পি, আল জাজিরা, বি বি সি, ফ্রান্স ২৪


পটভূমি

ফ্রান্সে ইউরোপের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর আবাস। এই দেশে প্রায় ৬০ লক্ষ মুসলিম জনগোষ্ঠী বসবাস করে যা ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ। লেসিটি নামক আন্দোলনের ফসল হিসেবে, ১৯০৫ সালে একটি আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং চার্চকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে নিরপেক্ষ থাকার নীতি বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ফ্রান্সে বিশেষ করে চার্লি হেবদো নামক পত্রিকায় বারে বারে মুসলিমদের নবীকে নিয়ে ব্যাঙ্গ কার্টুন প্রকাশ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়। মুসলিম সন্ত্রাসীদের আক্রমণে চার্লি হেবদো পত্রিকা সহ জনগনের জীবন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের মারাত্নক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে বাটাক্লান থিয়েটার এবং প্যারিসের আশেপাশের অন্যান্য স্থানে  সমন্বিত বোমা হামলা ও গোলাগুলিতে ১৩০ জন নিহত হন – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটা ছিল ফ্রান্সের অভ্যন্তরে পরিচালিত সবচেয়ে মারাত্মক হামলা। হামলাকারীদের বেশিরভাগ ফরাসি বা বেলজিয়ামের নাগরিক যারা ইসলামিক স্টেট (আইএস) গ্রুপের সাথে লড়াইয়ে যুক্ত হওয়ার  জন্য তুরস্ক হয়ে ইরাক ও সিরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন।

প্যারিসের সন্ত্রাসবাদী হামলার পাঁচ বছর পরে এবং ফরাসী রাজধানীতে সম্প্রতি নৃশংস ছুরি হামলার এক সপ্তাহ পরে ফরাসী রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রন শুক্রবার আসন্ন একটি আইন করার ঘোষণা প্রদান করেছেন। এক ঘণ্টার এই ভাষণে তিনি ইতিবাচক কথা যেমন বলেছেন তেমনি কিছু কথা ধর্মীয় মূল্যবোধকে আঘাত হিসেবে বিবেচিত হওয়া মোটেও অযৌক্তিক হবে বলে মনে করা যায় না। বিশেষ করে “ইসলাম আজ সারা বিশ্বে সংকটে” এই কথা বিশ্ব মুসলিমদের আবেগে আঘাত বলে বিবেচিত হতে পারে। তার বিবেচনা করা উচিত যে, আজ বিশ্ব মুসলিম যে সংকটে পতিত হয়েছে তার মূল কারণ হচ্ছে “ঔপনিবেশিকতা“ আর এই ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যতম সারথি ছিল এই ফরাসী সম্প্রসারনবাদ। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো মুসলিম দেশগুলোকে দীর্ঘদিন শোষণ করে আজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশে বিভক্ত করে দিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে রেখেছে। পশ্চিমা বিশ্ব আজো মুসলিম বিশ্বে তাদের আগ্রাসন বিভিন্নভাবে বজায় রেখেছে।

ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলে, ধর্মীয় মূল্যবোধকে বারে বারে আঘাত করার নীতিকে সমর্থন দিয়ে ফরাসী রাষ্ট্র যে ধর্মীয় অসৌজন্যতার ভিত্তি রচনা করছেন সেটা কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। ইমানুয়েল ম্যাক্রনের গত্রকালের এই বক্তৃতা ফ্রান্সের মুসলিমদের নিকট কিভাবে গৃহীত হবে তা দেখার বিষয়। তবে ফ্রান্সের মূসলিমদের যদি সঠিকভাবে ফরাসী মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যদি তাদের স্বাধীনভাবে ধর্মীয় কার্য্য পরিচালনার সুযোগ প্রদান করা হয়, শিক্ষা দীক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে তাদেরকে যদি পাশাপাশি রাখা যায় তাহলে ফ্রান্সে সম্প্রীতির ধারা প্রকাশিত হবে তবে কোনভাবেই ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করার মাধ্যমে নয় বরং ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান করার মাধ্যেমেই তা অর্জন করা সম্ভব। 

SHARE THIS ARTICLE