ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ বাংলাদেশে বন্যার পানির মত বাড়ছে কোভিডের সংক্রমণ। ধারাবাহিকভাবে গত তিনদিন থেকে প্রতিদিন ৭ হাজারের বেশী নূতন রোগী শনাক্ত হয়েছে। নূতন সনাক্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তার সাথে তাল দিয়ে বাড়ছে মারাত্নক অসুস্থদের সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যুর পরিসংখ্যান। প্রতিদিনই পরিসংখ্যানের রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। সংক্রমণের প্রথম তরঙ্গে বয়স্কদের অবস্থা জটিল হয়েছিল বেশী মাত্রায় কিন্তু এবারের তরঙ্গে চিত্র বদল হয়েছে; তরুণ, যুবকরাও রক্ষা পাচ্ছেন না। স্বাভাবিকভাবেই মারাত্নক আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশই ভুগছেন শ্বাসকষ্টের সমস্যায়। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে দ্রুত, যার কারণে অতিরিক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা দ্রুত বাড়ছে আর সেই সাথে বাড়ছে আই সি ইউ শয্যার প্রয়োজন।
গত বছরের ৮ই মার্চ ব্যাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর বাড়তে থাকে সংক্রমণ। জুন-জুলাইতে সংক্রমণের গতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। জুলাইতে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই রেকর্ড ভেঙে গতকাল দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সংক্রমণে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে রেকর্ড। গতকালও আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ২১৩ জন। এই বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দিতে হাসপাতালগুলোতে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ শয্যা, অক্সিজেন ও পরিসেবা সংকট। রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। স্বজনরা রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে এক হাসপাতালের বারান্দা থেকে আরেক হাসপাতালের বারান্দায় ঘুরপাক খাচ্ছেন। সবাই একটি শয্যা চান। দিনে দিনে হাসপাতালে শয্যা সংকট প্রকট হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, “আমাদের সর্বনিন্ম শনাক্ত ছিলো ২.৩%। বাড়তে বাড়তে এটা এখন ২৪% এসে দাঁড়িয়েছে। আগের তুলনায় ১০ থেকে ১১ গুণ রোগী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ১১ গুণ রোগীকে হাসপাতালে জায়গা দিতে হলে বেড বাড়াতে হবে। যা সম্ভব নয়।” তিনি বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে ঢাকার সমস্ত হাসপাতালে বেড বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। ননকোভিড রোগীদের সরিয়ে কোভিড রোগীর জন্য ব্যবস্থা করছি। আড়াই হাজার শয্যাকে পাঁচ হাজার করা হয়েছে। প্রাইভেট হাসপাতাল গুলোকেও কোভিড হাসপাতাল করে দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকেও অনুরোধ করেছি হাজারের মতো বেড বাড়ানোর জন্য। প্রতিদিন যদি ৪-৫ হাজার রোগী বাড়ে তাহলে সারা শহরকে হাসপাতাল বানালেও সামাল দেওয়া সম্ভব না।”
আমি নিজে কথা বলেছি ঢাকায় আক্রান্ত কয়েকটি পরিবারের সাথে। একজন রোগীকে প্রাথমিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। দুই দিন পর তার অবস্থার অবনতি হলে আই সি ইউ শয্যার প্রয়োজন দেখা দেয় কিন্তু আই সিউ বেড ফাকা না থাকায় ঢাকার প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করেন স্বজনরা, কোথাও শয্যা খালি না পেয়ে অবশেষে গ্যাস্ট্রো লিভার হাসপাতালে একটি শয্যা পাওয়া যায়। এখনো তিনি সেখানেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
আরেকটি পরিবার ঢাকার কোন সরকারী হাসপাতালে আই সি ইউ শয্যা ফাকা না পেয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে আই সি ইউতে ভর্তি করেছেন কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতালে অত্যধিক ব্যয় বহনের ক্ষমতা না থাকায় আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। আমরা এখনো সরকারি কোন হাসপাতালে শয্যা ব্যাবস্থা করতে পারিনি। অনেক রোগী অক্সিজেন কিংবা আই সি ইউ তে শয্যা ফাকা পাবার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। পরিস্থিতি প্রতিদিনই আরও সংকটাপন্ন হচ্ছে। এই হারে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে কি হবে সেটা কল্পনা করতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল সরকারি হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ ফাঁকা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে এবং রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে কোনো আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ৩টি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বার্ন ইউনিটে মাত্র একটি ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয়টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। তবে সরকারি হিসাবে ১০টি ফাঁকা দেখালেও রোগী নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাতে পারছেন না স্বজনরা। এমপি-মন্ত্রীকে ফোন দিয়েও সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা মিলছে না। রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত ১৫টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। এর মধ্যে স্কয়ার হাসপাতালে চারটি, ইউনাইটেড হাসপাতালে আটটি, এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনটি আইসিইউ ফাঁকা ছিল। চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতালে ১৫টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ১০টি আই সি ইউ শয্যা ফাকা ছিল।
গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরুর পরেই স্বাস্থ্য খাতে সংকটের চিত্র উঠে আসে। সরকারীভাবে জানানো হয় শয্যাবৃদ্ধির কথা। এ বছরের মার্চের প্রথম দিকে সারা দেশের করোনা রোগীদের জন্য শয্যা ছিল ১০ হাজার ২৮৩টি, আইসিইউ ছিল ৫৬৬টি। ঢাকার হাসপাতালে শয্যা ছিল ৩ হাজার ১৯৩টি, আইসিইউ ছিল ২৮১টি। সরকারের পক্ষ থেকে রাজধানীতে আরও ১০০ টি আই সি ইউ শয্যা বাড়ানোর কথা জানানো হয়েছে। হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়ালেও চিকিৎসা পরিসেবা কতটুকু দেয়া যাবে সেটা মারাত্নক প্রশ্ন কেননা আই সি ইউ পরিসেবা দেবার মত জনবল কোথায়?
এদিকে সরকার এক সপ্তাহের লক ডাউন ঘোষণা করেছেন। এ যেন লক ডাউন নয় ছুটিতে দেশে যাবার হিড়িক পড়েছে। লক ডাউন বাড়ানোর চিন্তাভাবনা চলছে। কিন্তু এক সপ্তাহের লক ডাউনের সিদ্ধান্ত কি উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এদিকে লক ডাউন বিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য আসবে কোত্থেকে? লক ডাউন দীর্ঘ হলে দৈনিক শ্রমিকদের জন্য বিপর্য্যয় নেমে আসবে। একদিকে অসুস্থতা অন্যদিকে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। সমন্বিত কোন পরিকল্পনা এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। দিনে দিনে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। টিকা ব্যাবস্থাপনায় সরকারের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয় কিন্তু ভারতীয় এস্ট্রা জেনেকার টিকার সময়মত সাপ্লাই চেনের ব্যর্থতায় সেখানে দেখা দিয়েছে হতাশা।
সব কিছু মিলিয়ে, দেশে মহামারী একধরনের জটিল সংকট সৃষ্টি করেছে। এই সংকট উত্তরণের কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছেনা আর কয়েকদিন এরকম সংক্রমণ বাড়তে থাকলে পথে পথে লাশের মিছিল হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো, আমাদের সময়, বাংলাদেশ প্রতিদিন