যুক্তরাষ্ট্র থেকে, আসিফ মুক্তাদিরঃ আপনার কোলে জন্ম নেয়া সন্তানটি আসলে কতটুকু আপনার? এই প্রশ্নটি শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও একবার ভেবে দেখুন। আপনার মনযোগটুকু অন্যদিকে সরিয়ে আনি। বলুন তো, আপনার ঘরের খাঁচার ভেতরের পাখিটি কার? আপনি কোনো চিন্তা না করেই হয়ত বলবেন, “অবশ্যই আমার!” একটু ভেবে বলুন তো, আসলে পাখিটা কি আপনার? আপনি চেয়েছেন বা অর্থ খরচ করেছেন বলে পাখিটা পুরোপুরি আপনার হয়ে গেল? পাখিটা কিন্তু কখনও আপনার খাঁচায় আসতে চায়নি। আপনিই পাখিটাকে জোর করে নিয়ে এসে আপনার খাঁচায় বন্দী করে রেখেছেন। পাখিরা মুক্ত প্রাণী, এরা একটি খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকতে পারে না। পৃথিবীর মুক্ত আকাশে বাতাসে এবং প্রকৃতির সাহ্নিধ্যেই এদের সুখ এবং জীবনের সার্থকতা। এটা মোটামুটি আমার সবাই কমবেশি জানি। তারপরও আমরা পাখির পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করি, পাখিদের খাঁচায় রাখি, নিজ হাতে খাওয়াতে পছন্দ করি। কারণ এতে আমরা প্রচুর আনন্দ পাই। ভালোবাসা বোধ করি বা নিজের একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা করি। আমাদের জীবনটা একটু সহজ হয়ে যায়।
একবার ভাবুন, আমাদের জীবনকে একটু সহজ করতে, একাকিত্ব দূর করতে বা একটু ভালোবাসা দিতে বা পেতে আমরা আরেকটি প্রাণীর সহজাত জীবন ধ্বংস করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করি না। খাঁচার পাখি হয়ত কোনো উপায় না দেখে একদিন তার বাস্তবতা মেনে নেয়। কিন্তু খাঁচার ভেতরে সে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। একদিন পাখিটার অপমূত্যু বা অকালমৃত্যু ঘটে। আবার পাখির মালিক যদি কোনোভাবে পাখির আগে মারা যায় তখনও পাখিটি বেশিদিন টিকে না কারণ পাখির মালিক পাখিটিকে তার অনুপস্থিতিতে খাঁচার দরজা খুলতে কিভাবে হয় শেখায়নি। তাই পাখিটা একা একা খাঁচার ভেতর ছটফট করে মারা যায়।
এবার মূল কথায় ফিরে আসি। আপনার কোলে জন্ম নেয়া সন্তানটিও খাঁচায় বন্দী পাখিটার মতো। একবার ভেবে দেখুন, আপনার সন্তান কতটুকু আপনার? বিখ্যাত লেবানিজ লিখক, কবি এবং দার্শনিক খলিল জিবরানের ভাষায়,
নিজস্ব কোন সম্পদ নয় তোমাদের সন্তান, তারা তোমাদের জীবনের কামনা-বাসনা-আকাঙ্ক্ষার বরপুত্র; তারা তোমাদের মাধ্যমে এ জগতে আসে কিন্তু তোমাদের নিকট থেকে নয়, তারা তোমাদের দায়িত্বে থাকলেও তারা তোমাদের কোন সম্পদ নয়। তাদের ভালবাসা দিতে পারো কিন্তু তোমাদের "চিন্তা" নয়, তাদের নিজস্ব চিন্তার জগত আছে। তাদের "দেহ"কে তোমাদের ঘরে রাখতে পারো কিন্তু তাদের "আত্মা"কে নয়, তাদের "আত্মা" বাস করে আগামীদিনের অন্তরে, তাদের মত হতে চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু তাদের "তোমাদের মত" করার চেষ্টা করোনা।
পিয়াতামাতা তাদের নিজস্ব একাকীত্ব দূর করার জন্য, তাদের সুখ এবং আনন্দের জন্য সন্তানকে ভালোবাসা দিয়ে থাকে আর অবচেতন মনে তাদের দেয়া ভালোবাসার বিনিময় কামনা করে। আপনার সন্তানের ইচ্ছার কি কোনো দাম ছিল না? একবার আপনার সন্তানকে জিজ্ঞেস করুন, সে কি তার নিজ “ইচ্ছা”য় আপনাকে পিতা-মাতা হিসেবে মেনে নিয়েছে?
তাহলে ভেবে দেখুন, আপনার সন্তানকে আপনার মাধ্যমে পৃথিবীতে এনে তার উপর আপনার সকল স্বার্থন্বেষী ইচ্ছাগুলো কেন চাপিয়ে দেবেন? এই কথাটা কতটুকু সঠিক? প্রথমে একটি বন্য পাখিকে যখন খাঁচার ভেতরে রাখা হয়, তখন সে ভীষণ ছটফট করে, চিৎকার চেঁচামেচি করে। যেমনটা করে একটি বাচ্চা জন্ম নেয়ার সময়। খাঁচার পাখিটার চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে যেমন ভালোলাগে, তেমনি সন্তান প্রসবের পর তাদের কান্নাও শুনতে ভালো লাগে। এটা কি নিছক অমানসিকতা নয়? এই ছোট্ট জীবনে কত সন্তানের আত্মহত্যার ঘটনা শুনেছি বা দেখেছি। কত সন্তানকে বাড়ি ত্যাগ করে নিখোঁজ হতে দেখেছি। কত সন্তানের করুণ নিঃশব্দ আর্তচিৎকার শুনেছি। কিন্তু এমনটাইবা কেন? আপনার সন্তানকে মুক্ত করুন, তাদের চিন্তা ভাবনাকে স্বাধীনতা দিন। তাদের শারীরিক এবং মানসিক গঠনের পর নিজের সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ দিন। কিছু পিতামাতা প্রত্যক্ষভাবে ভালোবাসার অজুহাতে সন্তানের ওপর কঠিন নিয়ম এবং প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতন করে থাকেন। আবার কিছু পিতামাতা পরোক্ষভাবে ভালোবাসার দেয়ার নামে সন্তানদের নিজের কাছে আগলে রাখতে চান, যেন সন্তানটি তার হাত থেকে ফসকে না যায়। তাই তিনি তার সন্তানকে বাস্তবজীবন সম্পর্কে কিছু না শিখিয়ে সন্তানের সব কিছু তিনি করে দেন। যেমন, ১৫-১৬ বছরের সন্তানকে মা এখনও নিজ হাতে খাইয়ে দেন। একবার ভেবে দেখুন আপনার যদি হঠাৎ কিছু হয় তাহলে কি আপনার জন্ম দেয়া এই মানুষটি পৃথিবীতে একা টিকে থাকতে পারবে?
এটা সত্য যে, আপনি আপনার সন্তানের জন্ম থেকে প্রচুর শারীরিক কষ্ট থেকে শুরু করে অনেক অর্থও ব্যয় করেছেন। তার মানে এই নয় যে, তার ওপর আপনার শতভাগ অধিকার। সে এক মানুষ, যাকে আপনি তার ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই এই সংসারে এনেছেন। যেহেতু আপনি তার পেছনে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করেছেন, তার মানে এই নয় যে তার উপর আপনার সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন। আপনি যাতে কষ্ট না পান সেজন্য সে হয়ত আপনার অনেক সিদ্ধান্তই মেনে নেবে। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, আপনার সন্তান হবার পাশাপাশি সেও একজন মানুষ, তাদের চিন্তা কিংবা আত্নার নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে নেই। যেমন ঘরে খাঁচাবন্দী পাখিটি আসলে একটি বন্যপাখি, তার শরীরকে আটকে রাখলেও তার চিন্তা কিংবা আত্নাকে বন্দি রাখা যায়না। তাই আপনার সন্তানকে মুক্ত চিন্তায় বড় হয়ে উঠতে দিন। তার আত্নাকে বিকশিত হতে দিন। তাকে তার নিজের মতো বাঁচতে দিন।