এস, এম, মাহফুজুল হক, লূকান,ডাবলিনঃ (এটি একটি মৌলিক গল্প। বাস্তবের কোনো ঘটনার হুবহু বর্ণনা নয়। গল্পের প্রধান চরিত্র দুটি স্বভাবতই কাল্পনিক। কারো জীবনের সাথে মিলে যাওয়া নিতান্তই দৈব-দূর্ঘটনা। – লেখক)
ক্লাস থেকে ফিরেই কামরুননাহার লতা হাত-মুখ ধুতে গেলো। আলেয়া টিচার্স রুমে ঢুকে একবার মোটা গলায় আওয়াজ দিলো, দুপুরের খাবার টেবিলে সাজানো হয়ে গেছে। এই মহিলার গলা সুমধুর নয়। কিন্তু তার হাতের রান্না চমৎকার। লতা ম্যাডাম ওয়াশরুম থেকেই উত্তর দিলো, এক্ষুনি আসছি। ঠিক তখনই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। শাড়ীর আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সে দ্রুত বেরিয়ে এলো। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখলো, একটি অপরিচিত নাম্বার। শুধু তাই নয়। মনে হচ্ছে, বিদেশ থেকে কেউ ফোন করছে। সে ইতস্তত করছে। একে তো এখন অসময়। লাঞ্চের পর আরও একটি ক্লাস নিতে হবে। তার উপর আবার না জানি কোন উটকো ঝামেলার ফোন। ভাবছে, ফোনটা সে ধরবে না। খেতে যাবে। কিন্তু ফোনটা একবার কেটে গিয়ে আবারও বাজতে লাগলো। একটু বিরক্তি নিয়েই সে বললো,
- হ্যালো,
- হ্যালো, লতা? আমি আনিস। আমি আয়ারল্যান্ড থেকে বলছি। লতা, আমি অনেক কষ্টে তোমার নাম্বারটা জোগাড় করতে পেরেছি। প্লিজ, আমার কথা একটু শোনো। আজ বারোটি বছর। একটি যুগ। বিশ্বাস করো। সত্যি বলছি। আমি তোমার কথা কখনোই ভুলতে পারি নি। কিন্তু আমার পিছনে ফিরে যাবার কোনো উপায় ছিলো না। একটি উন্নত দেশে উন্নত জীবনযাপনের জন্য। বড় ক্যারিয়ার গড়ার জন্য। পরিবারের ভালোর জন্য। আমাকে সেদিন একরকম পালিয়ে আসতে হয়েছিলো। আমি জানি। আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করো, প্লিজ। বিশ্বাস করো, লতা। এক বুক যাতনা আমাকে আজও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমি সবসময় ভেবেছি। একদিন তোমার সামনে যাবো। দু’হাত তুলে ক্ষমা চাইবো। যে শাস্তি দেবে, মাথা পেতে নেবো। প্লিজ লতা, আমাকে তুমি ভুল বুঝো না। আমাকে ক্ষমা করো।
কথাগুলো আনিস একনাগাড়ে হরহর করে বলে চলেছে। ফোনের অপরপ্রান্তে কোনো সাড়া নেই। তবে বরফ গলার শব্দ ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে। আনিস একটু থামলো, - লতা, শুনছো?
- তুমি কেমন আছো, আনিস?
- ভালো…না…হ্যাঁ…মানে…।
আনিস অর্থহীন গলায় কিছু শব্দ বলে। - তুমি এখন কোথায়, আনিস?
- আয়ারল্যান্ডে। আসলে আমি ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটিতে একটি স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। মাস্টার্স করার জন্য। তোমাকে বলা হয়নি।
- তুমি বিয়ে করেছো?
- হ্যাঁ। ও আইরিশ। সত্যি বলতে কি, এদেশে থাকার জন্য এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।
- দেশে কবে আসবে?
- হ্যাঁ। দেশে আসার প্লান করছি। সামনের গ্রীষ্মের ছুটিতেই হয়তো আসবো।
- তোমার বউকে নিয়ে আসবে?
এই প্রশ্নের জন্য আনিস একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সে থতোমতো খেয়ে গেলো। একটু থেমে সে বললো, - না। আমি একাই আসবো। কিছুদিনের জন্য।
লতার নারীমন দ্রুত বুঝে নেয় কিছু। সে শান্ত স্বরে বললো, - আনিস, যে দিন চলে যায় সে কি আর ফিরে আসে? না-কি তাকে আবার ফিরিয়ে আনা যায়?
আনিস বুঝতে পারে না সে কি বলবে। লতাই বা তাকে কি বোঝাতে চাচ্ছে। - আনিস, তুমি তো জানতে আমি তোমাকে কতো ভালোবাসতাম। আমার কতো স্বপ্ন ছিলো। তোমাকে নিয়ে। আমাকে নিয়ে। তুমি চলে যাবার পর একটি বছর আমি কতো কষ্ট করেছি। তোমাকে ভুলে যাবার কতো চেষ্টা করেছি। পড়াশোনায় মন দিয়েছি। নতুন জীবন গড়তে চেয়েছি। আর বাসার কথা কি বলবো? কতো যে ঝামেলা গেছে। কতো যে কথা শুনতে হয়েছে পরিবারের সকলের কাছ থেকে। তা আমি তোমাকে কিছুতেই বোঝাতে পারবো না ।
- লতা, তুমি কি বলতে চাইছো?
- আনিস, তোমরা ছেলেরা সময়ের দাবীকে সময় থাকতে নিদারূনভাবে উপেক্ষা করো। তারপর সেই সময় যখন একদিন হারিয়ে যায়। পৃথিবীও বদলে যায়। তোমরা তখন তাকে আবার নতুন করে খোঁজো। কেনো, আনিস?
ডাবলিনের আবহাওয়া আজ প্রচন্ড রকম সুন্দর। চমৎকার রোদ। সারা আকাশ জুড়ে নীল চাদর। আনিসের অফিস শহরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। সারি সারি দৃষ্টি কাড়া সুরম্য অট্টালিকা। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নিঃশব্দ, অপ্রশস্ত জলধারা – গ্র্যান্ড ক্যানাল। একটু দূরে সেটি মিশে গেছে আইরিশ সাগরের মোহনায়। ক্যানালের দুই ধারে দীর্ঘ হাঁটা পথ। কিছুদূর পর পর রয়েছে বসার জন্য কিছু বেঞ্চ। সাগরের কাছাকাছি হওয়াতে গাংচিলের আনাগোনা এখানে খুব বেশি। বেশ কিছু রাজহাঁসও আছে জায়গায় জায়গায়। বাচ্চাশিশুকে নিয়ে অল্পবয়সী এক মা এসেছে। টুকরো টুকরো পাউরুটি ছুঁড়ে দিচ্ছে পাখিগুলোর দিকে। একটু দূরে একজোড়া রাজহাঁস ঠোঁট দিয়ে একে অপরকে মৃদু আঘাত করছে। ভালোবাসা শুধু মানুষকে নয়, প্রাণীকূলকেও আন্দোলিত করে। সেই আন্দোলনের ঢেউ কাউকে করে সংসারী। আর কেউ বা হয় বৈরাগী। তাহলে আনিস? সে কি সংসারী? না বৈরাগী?
আনিস পাশের একটি কর্নার শপে ঢুকলো। একটি লম্বা পাউরুটি কিনে এনে বেঞ্চে এসে বসলো। একটি-দুটি গাংচিল তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার দৃষ্টি ঐ রাজহাঁস যুগলের দিকে। কী অপূর্ব জাদু মায়ায় তারা একে-অপরকে ভালোবাসছে।
ডাবলিন
৫ই মে, ২০২০