আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ সার্বিয়ায় একজন বাংলাদেশি অভিবাসীর রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে৷ সোমবার মধ্যরাতে বলকান দেশটির রাজধানী বেলগ্রেড থেকে লরিতে লুকিয়ে ইটালিতে যাওয়ার সময় তার মৃত্যু হয়৷
নিহত অভিবাসীর নাম বাদল খন্দকার৷ তিনি গতবছরের নভেম্বরে বৈধ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে কাজ করতে সার্বিয়া গিয়েছিলেন৷ কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করতে গিয়েছিলেন সেটির বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব ছিল না বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা৷
বাদলের শ্যালক সাদ্দাম হোসেন ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘সম্পূর্ণ বৈধভাবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অনুমতি নিয়ে এবং বাংলাদেশি একটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়ে তিনি সার্বিয়া গিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর কাজ করতে না পারায় হতাশ হয়ে পড়েন৷’’
যারা বাদলকে সার্বিয়া পাঠিয়েছেন, তারাই তাকে পরবর্তীতে সার্বিয়া থেকে ইটালিতে যাওয়ার পরামর্শ দেন বলে জানান সাদ্দাম৷ ইটালি পৌঁছাতে পারলে তাদের আরো পাঁচ লাখ টাকা দেয়ার কথা ছিল৷
গেম মারার সময় অজ্ঞান
সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড থেকে ইটালির উদ্দেশে যাত্রা করার আগে দেশটির সীমান্তবর্তী শহর কিকিন্দায় অভিবাসী শিবিরে ছিলেন বাদল খন্দকার৷ সেখানে বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় তার একটি আইডি কার্ডের কপি রয়েছে ইনফোমাইগ্রেন্টসের কাছে৷ কার্ডে থাকা তথ্য অনুযায়ী, তার জন্ম হয়েছিল ১৯৯৪ সালে, যদিও সাদ্দাম জানিয়েছেন বাদলের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি৷ তার দেড় বছর ও পাঁচ বছর বয়সি দুটো সন্তান রয়েছে৷
কিকিন্দা ক্যাম্প থেকে সোমবার রাতে প্রথমে ট্যাক্সিতে করে বেলগ্রেডের সার্সিন এলাকায় যান বাদল খন্দকার৷ সেসময় তার সঙ্গে ছিলেন আরো তিনজন বাংলাদেশি৷ তাদেরই একজন নামপ্রকাশ না করার শর্তে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘সার্সিন থেকে লরিতে করে আমরাসহ ভারতীয়, আফগান এবং অন্যান্য দেশের মোট ৩০ জনকে ইটালিতে পাচার করছিল একদল আফগান মানবপাচারকারী৷’’
পাচারকারীরা তাদের সার্সিনের একটি ঘরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে দেন৷ এরপর রাত দুটোর দিকে তাদেরকে ইটালিগামী একটি লরিতে তোলা হচ্ছিল৷ সেই লরিতে ওঠার আগ মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে পড়েন বাদল৷
তার সঙ্গে থাকা সেই বাংলাদেশি বলেন, ‘‘অন্য দুজনের সঙ্গে আমিও লরিতে উঠে যাই৷ আমার পরে বাদলের ওঠার কথা ছিল৷ কিন্তু তিনি লরিতে ওঠার আগ মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান৷’’
সেই ঘটনার পরপরই লরি থেকে নেমে যান বাংলাদেশিরা এবং নানাভাবে নিজেদের মতো করে বাদলের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেন৷ অজ্ঞান হওয়ার পর পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুবার নড়াচড়া করেছিলেন বাদল৷ তবে তার জ্ঞান আর ফেরেনি৷ আফগান পাচারকারীরা সেসময় তাদের এম্বুলেন্স বা পুলিশে ফোন করতে দেয়নি বলেও জানান সেই বাংলাদেশি৷
তিনি বলেন, ‘‘আফগান পাচারকারীরা তাদের ‘গেম স্পটটি’ গোপন রাখতে চেয়েছিলেন৷ তারা আমাদেরকে সোজা রাস্তায় বাদলকে নিয়ে যেতেও দেননি৷ আমরা তিনজন পরে তাকে কাঁধে করে একটি ক্ষেতের মধ্য দিয়ে রাস্তায় নিয়ে যাই৷’’
বসনিয়া ও সার্বিয়া থেকে নানাভাবে অনিয়মিত পথে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশে পৌঁছানোকে অভিবাসী ও মানবপাচারকারীরা ‘গেম’ বলেন৷ বিভিন্ন অংকের টাকার বিনিময়ে এই ‘গেম মারা’ হয়৷
দুই ঘণ্টা পর চিকিৎসা
বাদলের সঙ্গে থাকা সেই বাংলাদেশি বলেন যে তারা রাস্তায় বিভিন্ন গাড়ি থামিয়ে বাদলকে সহায়তা করতে অনুরোধ করতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু কোনো গাড়িই তাদের সহায়তা করেনি৷ আর সেখানে ঘরবাড়িও তেমন ছিল না৷
এক পর্যায়ে ঘটনাস্থল থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটি পেট্রল পাম্পে পৌঁছানোর পর এম্বুলেন্স ডাকতে সক্ষম হন বাদলের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশিরা৷ ততক্ষণে দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে৷
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সেই বাংলাদেশি বলেন, ‘‘এম্বুলেন্স ডাকার ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরে ডাক্তার আসেন৷ তারা প্রাথমিক পরীক্ষার পর বাদলকে মৃত ঘোষণা করেন৷ আর পুলিশ আমাদের আট ঘণ্টার মতো জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়৷’’
হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু?
বাদল খন্দকারের মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি৷ তার সঙ্গে থাকা বাংলাদেশিরা ধারণা করছেন লরিতে ওঠার আগে সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তার৷
সার্বিয়ার সংবাদপত্র ‘ইনফর্মার’ এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘‘সার্সিন এলাকার কাছে ডোবানভচি বাইপাসের কাছে বাদল খন্দকারের মরদেহ পাওয়া গেছে৷ তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলে ইনফর্মার জানতে পেরেছে৷ সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে তার মৃত্যু হয়৷’’
তবে, বাদল খন্দকারের মৃত্যুর কারণ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি সার্বিয়া৷ দেশটির একটি সরকারি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি৷ মৃতের সঙ্গে থাকা উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ দেখে ধারণা করা হচ্ছে যে তিনি সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন৷ আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে সূত্রটি৷
মৃতদেহ ফেরত চায় পরিবার
নিহতের শ্যালক সাদ্দাম হোসেন জানিয়েছেন, তারা ইতিমধ্যে মরদেহ দেশে ফেরত আনার জন্য আবেদন করেছেন৷ এই ব্যাপারে বেসরকারি উন্নয়নসংস্থা ব্র্যাক এবং ইটালিতে বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের সহায়তা করছেন৷
রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডিপ্লোম্যাটিক কাউন্সিলর মো. জসিমউদ্দিন ইনফোমাইগ্রেন্টসক বলেন, ‘‘আমরা সার্বিয়ায় নিযুক্ত আমাদের অনরারি কনসালের মাধ্যমে বাদল খন্দকারের মরদেহ বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা করছি৷ মরদেহের সন্ধান পাওয়া গেছে৷ এখন কোন বিমানে পাঠালে কেমন খরচ হবে সেটা খোঁজ নেয়া হচ্ছে৷’’
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান জানিয়েছেন বাংলাদেশে পৌঁছালে বাদলের মরদেহ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে ৷ পাশাপাশি তিনি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন৷
হাসান বলেন, ‘‘আমি যতদূর জানি বাদল জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো ছাড়পত্র নিয়েই সার্বিয়া গিয়েছিলেন৷ এখন সরকারের উচিত তদন্ত করা যে তাকে কারা, কীভাবে বিদেশে পাঠিয়েছিল৷ কারণ পরিবার বলছে তিনি প্রতারণার শিকার৷’’
‘‘পাশাপাশি মৃত্যুর ঘটনা যেহেতু সার্বিয়াতে ঘটেছে, তাই আমাদের সরকার চাইলে সার্বিয়ার পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঘটনাটি তদন্ত করতে অনুরোধ করতে পারে’’ যোগ করেন তিনি৷
বলকান রুট হিসেবে পরিচিত সার্বিয়া এবং বসনিয়া থেকে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অভিবাসী অনিয়মিত পথে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের চেষ্টা করছেন৷ তারা মূলত ইটালি, ফ্রান্স এবং পর্তুগালের মতো দেশগুলোতে যেতে চান৷ সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস