আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ এনে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’- গঠন করে ব্যাবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেসিডেন্ট জনাব আব্দুল হামিদের নিকট একটি আবেদন পেশ করেছেন দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। গতকাল শনিবার এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলন করে নাগরিকদের পক্ষ থেকে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। এতে প্রেসিডেন্ট বরাবর দেয়া আবেদনের বিস্তারিত উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।
প্রেসিডেন্ট বরাবর আবেদনে বলা হয়, “বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণ করে আসছেন। কমিশনের সদস্যরা একদিকে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ। একইভাবে তারা বিভিন্নভাবে আইন ও বিধিবিধানের লঙ্ঘন করে গুরুতর অসদাচরণ করে চলেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগের তথ্য তুলে ধরা হয়।”
ওই আবেদনে সংবিধানের ৯৬ (৩), ৯৬ (৫) এবং ১১৮ (৫) এই তিনটি ধারায় প্রদানকৃত ক্ষমতাবলে জনাব নূরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যগণ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত আছেন বিধায় এবং কমিশনের সদস্যগণ গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিধায় তাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ব্যাবস্থা গ্রহণের দাবী জানান।
দীর্ঘ এই আবেদনে বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার অপূরণীয় ক্ষতি সাধনের জন্য দায়ী করে লিখেন, “আমাদের আশঙ্কা যে, তারা দায়িত্বে বহাল থাকলে আমাদের নির্বাচন তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। এ অবস্থায় কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে বলে আমরা মনে করি।”
আবেদনে কমিশনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করে বলা হয়, “২০১৯ সালের ৬ই আগস্ট প্রকাশিত প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশনারগণ নির্বাচনী প্রশিক্ষণের জন্য বক্তৃতা না দিয়েই উক্ত কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়েছেন। আর এই অর্থের পরিমাণ ২ কোটি টাকার বেশি।”
আবেদনে আরও বলা হয়, “২০১৯ সালের ২৫শে নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে কর্মচারী নিয়োগে ৪ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ তোলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। লিখিত বক্তব্যে কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় ৩৩৯টি শূন্যপদের বিপরীতে ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন প্রার্থী অংশ নেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র যাচাইয়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদকে ৪ কোটি ৮ লাখ টাকা দেয়া হয়। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ও অর্থ ব্যয় সমপর্কে নির্বাচন কমিশন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সংশ্লিষ্ট নথি তলবের মাধ্যমে উপযুক্ত তদন্তে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের গুরুতর অসদাচরণ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।”
এছাড়া, ২০২০ সালের ৩রা অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিনের করা একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৩ জন নির্বাচন কমিশনার নিয়ম-বহির্ভূতভাবে ৩টি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করছেন। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা ২টি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা একটি জিপ ও একটি প্রাইভেট কার ব্যবহার করতেন। তবে জুলাই মাস্যা সব নির্বাচন কমিশনারদের নতুন গাড়ি দেয়া হলেও ৩ নির্বাচন কমিশনার এখনো তাদের আগের ব্যবহৃত গাড়ি জমা দেননি। তারা বর্তমানে আগের জিপসহ ৩টি গাড়ি ব্যবহার করছেন। ইভিএম ক্রয়ে অনিয়মের বিষয়টিও উল্লেখ করেন বিশিষ্ট নাগরিকরা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম সম্পর্কে আবেদনে বিস্তারিত উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ৮ই নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম তফসিল (১২ই নভেম্বর পুনঃতফসিল ঘোষিত হয়) ঘোষণার মাত্র দু’দিন পর রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতায় দুই কিশোর নিহত হয়। এমন মর্মান্তিক ঘটনার পরও নির্বাচন কমিশন এই ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। নির্বাচনপূর্ব প্রচারণা চালানোর পুরো সময়ই নানাধরনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ১৭(৩)তে এসব আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কমিশনকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হলেও এ ব্যাপারে কমিশনকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নিতেও দেখা যায়নি, যা আইন প্রয়োগে কমিশনের ইচ্ছাকৃত এবং অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যর্থতা বলে আমরা মনে করি।
২০১৮ সালের ৩রা ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের দিন নানাধরনের অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। বিবিসি বাংলার এক সাংবাদিক চট্টগ্রাম-১০ আসনের একটি কেন্দ্রে সকালে ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই ব্যালটবাক্স ভরা দেখতে পান বলে বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ভোটগ্রহণের সারাদিনই পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাধরনের অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনের পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত এক জরিপেও আগের রাতে সিল মেরে রাখার অভিযোগ উঠে আসে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচিত ৫০টি আসনের মধ্যে ৩৩টি আসনেই আগের রাতে সিল মেরে রাখার ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছে টিআইবি।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম মামলার রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ উঠলে তদন্ত সাপেক্ষে নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে ওই কারচুপির অভিযোগগুলোর ব্যাপারে কোনো তদন্তের উদ্যোগ নিতে এবং কারো বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমরা দেখিনি। আইন প্রয়োগে এই অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নিষ্ক্রিয়তা নিঃসন্দেহে গুরুতর অসদাচরণ, যা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
আবেদনে আরো বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের ৬ মাস পর তথ্য অধিকার আইনের অধীনে বাধ্য হয়ে প্রকাশ করা কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণে অনেক অস্বাভাবিকতা এবং অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রকাশিত ফলাফল ছিল বহুলাংশে বানোয়াট। প্রকাশিত ফলাফল থেকে দেখা যায়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, যা কোনোভাবেই যৌক্তিক এবং সম্ভব নয়। কেননা তালিকাভুক্ত ভোটারের মৃত্যুবরণ, দেশের বাইরে অবস্থান, জরুরি কাজে এলাকার বাইরে অবস্থান, অসুস্থতা ইত্যাদি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া যেকোনো যুক্তিতেই অস্বাভাবিক। এ ছাড়া ৭,৬৮৯টি (মোট কেন্দ্রের ১৯.১৫%) কেন্দ্রে ৯০ ভাগ থেকে ৯৯ ভাগ ভোট পড়েছে যাও কোনোভাবেই স্বাভাবিক ও বাস্তবসম্মত নয়। কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে আরো দেখা যায়, ৫৯০টি কেন্দ্রে বৈধ ভোটের শতভাগ অর্থাৎ প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যে কয়টি ভোট বৈধ হয়েছে সব একটিমাত্র প্রতীকে পড়েছে। অন্যদিকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীরা ১,১৭৭টি (মোট কেন্দ্রের ২.৯৩%) কেন্দ্রে, লাঙ্গল প্রতীক ৩,৩৮৮টি (মোট কেন্দ্রের ৮.৪৪%) কেন্দ্রে, হাতপাখা প্রতীক ২,৯৩৩টি (মোট কেন্দ্রের ৭.৩০%) কেন্দ্রে, এমনকি সরকার দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী ২টি কেন্দ্রে কোনো ভোট-ই পাননি, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলাফলের এমন অস্বাভাবিকতা নির্বাচন কমিশনের গুরুতর অসদাচরণের প্রতিফলন।
আবেদন পাঠানো ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক হচ্ছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. আকবর আলি খান, এডভোকেট সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী, মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল ইউমেন্স ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক পারভীন হাসান, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড. আই খান পান্না, ড. শাহদীন মালিক, আলোকচিত্রশিল্পী ড. শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সি আর আবরার, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, লেখক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, সাধনার আর্টিস্টিক ডিরেক্টর লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন-এর অধ্যাপক, গবেষক স্বপন আদনান, ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সিনিয়র সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তুজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্লিনিক্যাল নিউরোসায়েন্স সেন্টার, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগ-এর প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।
তথ্যসূত্রঃ ডেইলি মানবজমিন