আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে ভোটের আগে হওয়া প্রায় সব জনমত জরিপেই জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে এগিয়ে রয়েছেন। এই এগিয়ে থাকা গত নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনের এগিয়ে থাকার চেয়ে বেশি ব্যবধানে। অর্থাৎ এবার এমন অনেকেই বাইডেনকে সমর্থন দিচ্ছেন, যারা ২০১৬ সালে হিলারিকে সমর্থন দেননি। একই দলের হওয়া সত্ত্বেও কেন কিছু লোক হিলারিকে সমর্থন না করলেও বাইডেনকে করছেন?
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এমন বেশ কিছু ভোটারের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যারা ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দেননি, কিন্তু এবার বাইডেনকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন। এমনই একজন লাস ভেগাসের বাসিন্দা সামান্থা ক্যাকমারিক। লাতিন এই তরুণী বলেন, হিলারি ক্লিনটনকে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর একজন হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।
একই কথা জানান কৃষ্ণাঙ্গ সংগীত প্রযোজক প্লাওয়ারস ফরএভার ও শ্বেতাঙ্গ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মী থমাস মোলিন। উভয়েই জানান, হিলারিকে তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁরা মনে করেছিলেন, হিলারি কোনো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারবেন না। উল্লিখিত তিনজনের কেউই গত নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দেননি। কিন্তু এবার বাইডেনকে ভোট দেবেন বলে মনস্থ করেছেন তিনজনই।
স্বতন্ত্র ভোটার থমাস মোলিন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আমার লোক নন, তা আমি শুরুতেই বুঝেছিলাম। কিন্তু যখন হিলারি ক্লিনটনের প্রসঙ্গ এল, তখন মনে হলো, তাঁর স্বামীর আট বছরের প্রশাসন আমাকে তুষ্ট করতে পারেনি।’ মোলিন ২০১৬ সালে লিবারেটারিয়ান প্রার্থী গ্যারি জনসনকে ভোট দেন। তবে এবার তিনি জো বাইডেনের ওপর আস্থা রেখেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এবার আমি নিজেকে বাইডেনের সঙ্গে অনেক বেশি সংযুক্ত মনে করছি। এতে আপনারা আমাকে পুরুষতান্ত্রিক বা অন্য অনেক কিছুই বলতে পারেন।’
থমাস মোলিনের মতো করে আরও অনেকেই ভাবছেন। ২০১৬ সালে স্বতন্ত্র ও ডেমোক্র্যাট ভোটারদের একটি বড় অংশ তৃতীয় কোনো প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন। এমনকি কেউ কেউ ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও ভোট দিয়েছিলেন। এবার আবার তাঁদের অনেকেই বাইডেনকে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। একেক জনের ক্ষেত্রে একেক কারণ কাজ করছে। কেউ ব্যক্তিগত, কেউ রাজনৈতিক, কেউ লৈঙ্গিক, কেউ ট্রাম্প-বিরোধিতা—এমন নানা কারণেই তাঁরা বাইডেনের পক্ষ নিচ্ছেন। বাইডেনের ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই। তাঁর চার বছরের একটি মেয়াদকাল পার হওয়ায় ভোটারদের পক্ষে আগের চেয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া তুলনামূলক সহজ হচ্ছে। এই সুবিধাটা নিশ্চিতভাবেই গেলবার হিলারি পাননি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আমার লোক নন, তা আমি শুরুতেই বুঝেছিলাম। কিন্তু যখন হিলারি ক্লিনটনের প্রসঙ্গ এল, তখন মনে হলো, তাঁর স্বামীর আট বছরের প্রশাসন আমাকে তুষ্ট করতে পারেনি।
গত নির্বাচনের চেয়ে এই নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী এমনিতেই এগিয়ে থাকার কথা। প্রথমত, গত নির্বাচনটি হয়েছিল টানা দুই মেয়াদে ডেমোক্রেটিক দলের শাসনের পর। দলটির প্রার্থী হিসেবে হিলারি ক্লিনটনের মনোনয়ন দুটি বিবেচনায় ধাক্কা খায়। প্রথমটি অবশ্যই নারী প্রশ্নে। দ্বিতীয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাঁকে নিয়ে তৈরি হওয়া কিছু অসন্তোষ। একই সময়ে ভারমন্ট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থান ও তাঁর পেছনে দলে দলে পরিবর্তনকামী তরুণদের সমবেত হওয়া দলের ভেতরেই বিভাজনের রেখা স্পষ্ট করে দেয়। দ্বিতীয়ত, এবারের কোভিড বাস্তবতা। করোনাভাইরাস অন্য সব দেশের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও অভিশাপ হয়ে এসেছে। ফলে এই সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া নানা ভুল সিদ্ধান্ত এবং খোদ প্রেসিডেন্টের নানা বিতর্কিত মন্তব্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে বাইডেনের জন্য।
এই সবকিছুরই সম্মিলিত প্রভাব পড়েছে এবারের জনমত জরিপগুলোয়। হিলারি ক্লিনটন সে সময় এমন অনেক সুবিধা পাননি, যা এবার বাইডেন পাচ্ছেন। বাইডেনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, আগেরবার মার্কিন জনগণের মধ্যে যে পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা ছিল গোটা ব্যবস্থা পরিবর্তনের। আর এবার ক্ষমতাসীন ব্যক্তিকে পরিবর্তনের বিষয়টিই মুখ্য হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে। ফলে ব্যবস্থা সম্পর্কিত অনেক জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে না বাইডেনকে। ফলে হিলারি ও বাইডেন একই প্রশাসনের অংশ থাকলেও হিলারির ক্ষেত্রে সে পরিচয় নেতিবাচক হয়ে উঠেছে, আর বাইডেনের ক্ষেত্রে সে প্রশ্নটিই ধর্তব্যে আসছে না।
গত নির্বাচনে রিপাবলিকান দল এর আগের ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঘটা অপ্রীতিকর সবকিছুর জন্য দায়ী হিসেবে হিলারিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ফলে তাঁর হয়ে প্রচার চালানোটা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ ক্ষেত্রে জো বাইডেন সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। শুনতে যেমনই লাগুক—এর কারণ হচ্ছে তিনি পুরুষ এবং একজন বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। এই কথাটা বলতে আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটাই সত্য।
এ বিষয়ে পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ওয়ারেন কাউন্টির ডেমোক্রেটিক চেয়ারম্যান অ্যারন স্টার্নস নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘গত নির্বাচনে রিপাবলিকান দল এর আগের ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঘটা অপ্রীতিকর সবকিছুর জন্য দায়ী হিসেবে হিলারিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ফলে তাঁর হয়ে প্রচার চালানোটা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ ক্ষেত্রে জো বাইডেন সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। শুনতে যেমনই লাগুক—এর কারণ হচ্ছে তিনি পুরুষ এবং একজন বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। এই কথাটা বলতে আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটাই সত্য।’
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, নির্বাচনী প্রচারে জো বাইডেন যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছেন, সেখানে সরকারের পরিসর বাড়বে। হিলারি কিন্তু সরকারের পরিসর এতটা বাড়ানোর কথা বলেননি। অথচ সেই লোকেরাই এবার বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার বিবেচনা করছেন, যারা হিলারিকে অনুদার ভেবেছিলেন। বাইডেনের রাজনৈতিক পরিচয় অনেক পুরোনো হলেও লোকেরা তাঁকে রাজনীতিক হিসেবে দেখছেন না; দেখছেন চ্যালেঞ্জার হিসেবে। আর হিলারির ক্ষেত্রে তাঁর রাজনীতিক পরিচয়টিই মুখ্য ছিল।বিজ্ঞাপন
উইসকনসিনের ২৭ বছর বয়সী ভোটার সারা ব্রাউন যেমন বললেন, ‘আমি হিলারিকে পছন্দ করতাম না। তাঁকে আমার প্রতারক মনে হতো। মনে হতো, তিনি মিথ্যা বলছেন।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সারা ২০১৬ সালে হিলারির বদলে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁর অবশ্য এখন অনুতাপের শেষ নেই। এবার তাই তিনি বাইডেনকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন। তাঁর মতে, ‘(ট্রাম্প-বাইডেন) দুজনের কাউকেই আমি পছন্দ করি না। কিন্তু এই দুই বিকল্পের মধ্যে আমার মনে হয় এটাই (বাইডেনকে ভোট দেওয়াটাই) কম ক্ষতিকর হবে।’
নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, গত নির্বাচনে সুইং স্টেটগুলোয় তৃতীয় কাউকে ভোট দিয়েছেন এমন সম্ভাব্য ভোটারদের ৪৯ শতাংশই বাইডেনকে সমর্থন করছেন। বিপরীতে ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন ১৯ শতাংশ ভোটার। আর নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে বাইডেন ট্রাম্প থেকে এগিয়ে রয়েছে ৯ শতাংশ পয়েন্ট ব্যবধানে। গেল নির্বাচনে যে শ্বেতাঙ্গ ও বয়স্ক ভোটারদের মধ্যে হিলারি সাড়া ফেলতে পারেননি, সেখানেই এবার উল্লেখযোগ্য সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন বাইডেন।
গত নির্বাচনটি হয়েছিল টানা দুই মেয়াদে ডেমোক্রেটিক দলের শাসনের পর। দলটির প্রার্থী হিসেবে হিলারি ক্লিনটনের মনোনয়ন দুটি বিবেচনায় ধাক্কা খায়। প্রথমটি অবশ্যই নারী প্রশ্নে। দ্বিতীয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাঁকে নিয়ে তৈরি হওয়া কিছু অসন্তোষ
এই আলোচনায় স্যান্ডার্সের প্রসঙ্গটি অবধারিতভাবেই আসবে। কারণ, গেল নির্বাচনে যে দুজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোর সরাসরি বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, তার একজন বার্নি স্যান্ডার্স, অন্যজন ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্যান্ডার্স ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়ন পাননি। কিন্তু এতে করে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে থাকা পরিবর্তন স্পৃহা হাওয়া হয়ে যায়নি। অন্যদিকে ট্রাম্প ছিলেন রাজনীতিরই বাইরের লোক। তিনিও পরিবর্তনের কথা বলছিলেন। ওয়াশিংটনকে ইঙ্গিত করে পুরো কাঠামোকে দাঁড় করিয়েছিলেন সমালোচনার কাঠগড়ায়। দুজনের এই ‘পরিবর্তন’ স্লোগানের মধ্যে পার্থক্য অনেকেই করতে পারেননি। ফলে দৃশ্যে টিকে থাকা ট্রাম্পই পেয়ে যান অনেক স্বতন্ত্র ভোটারের সমর্থন। এবার ট্রাম্প জমানায় চার বছর কাটানোর পর অনেকেরই সেই মোহভঙ্গ হয়েছে। ফলে তাঁরা বাইডেনকে দ্বিধাহীন সমর্থন জানাতে পারছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ডেমোক্রেটিক দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজন উধাও না হলেও, সে প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন প্রশ্নে তাঁরা ঐক্য স্থাপন করতে পারছেন আগের চেয়ে সহজে। এই সুবিধাটা হিলারি পাননি একেবারে।