ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ আয়ারল্যান্ডে কোভিডের প্রথম রোগীটি আসে ইতালি থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০২০, ডাবলিন বিমানবন্দর দিয়ে বেলফাস্টে চলে যান এই রোগী। ২৯শে ফেব্রুয়ারি ইটালি থেকে আসা একজন ছাত্রকে কোভিড পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত করা হয়, আয়ারল্যান্ডের পূর্ব দিকের একটি কাউন্টিতে। ১১ই মার্চ ন্যাস জেনারেল হাসপাতালে প্রথম একজন করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়, এটা ছিল আয়ারল্যান্ডে কোভিডে প্রথম মৃত্যু। ১২ই মার্চ আয়ারল্যান্ডে স্কুল, কলেজ এবং চাইল্ড কেয়ার বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে কোভিডের সংক্রমণ, ২৭শে মার্চের মধ্যে সংক্রমিত হন ২১২১ জন আর মৃত্যুবরণ করেন মোট ২২জন, সরকার সকলকে ঘরে থাকতে পরামর্শ দেন অর্থাৎ আয়ারল্যান্ড পুরোপুরি লক ডাউনে চলে যায়। লক ডাউন আরোপের পরও এপ্রিলের শেষে আক্রান্তের সংখ্যা এসে দাড়ায় ২০, ২৫৩ এবং মৃত্যুবরণ করেণ মোট ১১৯০ জন।
লক ডাউনের সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হয় ৩ মাসের বেশী সময়। জুন মাসের শেষের দিকে সংক্রমন কমে গিয়ে ৩০ জুন তারিখে একদিনে সংক্রমিত হন ১১ জন এবং মৃত্যুবরণ করেন ১ জন এবং এই সময়ে সর্বমোট সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ২৫, ৪৭৩ এবং সর্বমোট মৃত ছিলেন ১৭৩৬ জন। ইতিমধ্যে আয়ারল্যান্ড সরকার ধাপে ধাপে লক ডাউন কমিয়ে আনতে শুরু করেছিলেন, এর ফলশ্রুতিতে আবার সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে আবার বিধিনিষেধ পুনরায় বাড়ানো হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি পুনরায় সংক্রমণ বেড়ে গেলে ১৫ই অক্টোবর থেকে দ্বিতীয় দফা লেভেল ৫ বিধিনিষেধ পুনরায় আরোপ করা হয় তবে স্কুলসমূহ খোলা রাখা হয়। অক্টোবরের শেষে সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা দাড়ায় ৬১, ৪৫৬ এবং মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৯১৩ জনে।
এরপর আসে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ, সংক্রমণ বাড়তে থাকে এবং ডিসেম্বরের শেষে অর্থাৎ ৩০শে ডিসেম্বর তৃতীয়বারের মত পুনরায় পঞ্চম স্তরের লক ডাউন ঘোষণা করে আয়ারল্যান্ড সরকার। এই প্রতিবেদন লিখার সময়ে আয়রল্যান্ডে সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৯১, ৭৭৯, এর মধ্যে সম্পুর্ন আরোগ্য লাভ করেছেন ২৩, ৩৬৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ২২৩৭। এই ছিল খুব ছোট করে আয়ারল্যান্ডে আসা মহামারীর ধ্বংসাত্নক ক্রিয়ার সময়ের সংখ্যাতত্ত্ব।
আয়ারল্যান্ড একটি দ্বীপরাষ্ট্র হলেও, এই দেশ দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড যার রাজধানী ডাবলিন আর অন্য অংশ হচ্ছে উত্তর আয়ারল্যান্ড, যার রাজধানী বেলফাস্ট এবং এই অংশ যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত একটি রাজ্য। প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড ৫০ লক্ষ জন-অধ্যুষিত তূলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র, অন্যদিকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের জন্যসংখ্যা মাত্র ১৮ লক্ষ।
একটি দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে আয়ারল্যান্ড খুব সহজেই ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করতে পারার কথা ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে? দেখুন একটি দ্বীপে ভাইরাস আসার দুটো পথ তার একটি হচ্ছে আকাশ আর অন্যটি জলপথ। যদি আকাশ আর জলপথে আসা জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা যেত তাহলে সহজেই দ্বীপের অভ্যন্তরে ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পুর্ন রুদ্ধ করা খুব কঠিন ছিল বলে আমাদের মনে হয়না। কিন্তু দ্বীপটি দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার কারণে এই ঐক্য অর্জন কোনভাবেই সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতা কার? আমরা মনে করি এই ব্যর্থতাটা নেতৃত্বের!
এরপরও কিন্তু সংক্রমণের দ্রুত বিকাশ রোধে আকাশ আর জলপথে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইন করা গেলে সফলতা আরও বেশী হতে পারত, যা আয়ারল্যান্ড সরকার করেনি কিংবা করতে পারেনি। তবে ইউরোপের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্বের তুলনায় আয়ারল্যান্ড সরকারের সিদ্ধান্তসমূহ ছিল অগ্রণী, যার কারণে সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুহার তূলনামূলকভাবে কম হয়েছে। যদিও এর কারণে আপাতঃ অর্থনৈতিক দায়ভার বেশ হয়েছে, তবে এখানে মানবিকতার মূল্য অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বেশী প্রদর্শিত হয়েছে বলে আমাদের ধারনা।
সকলের মতোই আয়রাল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির বেশীরভাগ মানুষ গৃহবন্দী হয়ে পড়েন, কেউ কেউ চাকুরী হারান, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তবে সরকারের পক্ষ থকে সকলকে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান অব্যাহত থাকে এবং এখনো আছে।
প্রথম সংক্রমণের ঢেউয়ে বাংলাদেশী কমিউনিটির খুব অল্প সংখ্যক সদস্য কোভীড রোগে আক্রান্ত হন এবং ৪/৫ জনের মত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন এবং তাদের সকলেই আরোগ্য লাভ করেন বলে সংবাদ পাওয়া যায়।
তৃতীয় ঢেউ অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষ প্রান্তের সংক্রমণে বিভিন্ন কাউন্টিতে বেশ কিছু সংখ্যক বাংলাদেশী আক্রান্ত হবার সংবাদ পাওয়া গেছে, এদের মধ্যে কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেণ। শেষ সংবাদ পাওয়া পর্য্যন্ত ২/৩ জন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন কিন্তু তাদের সকলেই সুস্থ হওয়ার পথে। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ সকলকে সুস্থতা দান করুন, যেহেতু আবারো লক ডাউন চলছে এবং সেটা আগামী জানুয়ারি মাসের শেষাবধি চলবে বলে সরকারী সিদ্ধান্ত আছে, আমরা তাই সকলকে সাবধানতা অবলম্বনের অনুরোধ জানাচ্ছি।
এবারে একটি গল্প বলা যাক,
একদিন একটি মেয়ে তার বাবাকে এসে জানালো যে, তার জীবন শোচনীয় এবং সে কীভাবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাবে তা সে জানে না। একটি সমস্যা সমাধান হলে দেখা যাচ্ছিলো আরেকটি সমস্যা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্যা মোকাবেলায় লড়াই এবং সংগ্রাম করে সে ক্লান্ত।
তার বাবা ছিলেন একজন শেফ, তিনি তার মেয়েকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে, তিনটি হাঁড়িতে পানি ভরে বেশী করে আগুনে জাল দিতে থাকলেন।
কিছু সময় পর তিনটি হাঁড়ির পানি যখন ফুটতে শুরু করল, তখন একটি পাত্রে আলু, অন্য পাত্রে ডিম এবং তৃতীয় পাত্রটিতে কফির গুড়া দিয়ে সেদ্ধ করতে থাকলেন। দুটো টুল নিয়ে এসে একটাতে তিনি অন্যটাতে মেয়েকে বসিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন। মেয়েটি তার বাবার কাণ্ড দেখে ভাবছিল, কি হচ্ছে এসব?
কিছুক্ষণ পর তিনি চুলাগুলোর আগুণ নিভিয়ে দিয়ে, প্রথম হাড়ি থেকে আলুগুলো বের করে একটি পাত্রে, দ্বিতীয় হাড়ি থেকে ডিমগুলো বের করে আরেকটি পাত্রে আর তৃতীয় হাড়ির কফি একটি কাপে ঢেলে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, কি দেখছ? মেয়ে বলল, কেন? “আলু, ডিম এবং কফি?”
বাবা মেয়েটিকে কাছে ডেকে বললেন, হাত দিয়ে দেখো। মেয়ে আলুতে হাত দিয়ে দেখল আলুগুলো খুব নরম হয়ে গিয়েছে। এরপর বাবা মেয়েটিকে ডিমগুলো ভাঙ্গতে বললেন, ডিমের উপরের খোসা ফেলে দেবার পর দেখা গেলো ভিতরের ডিম শক্ত হয়ে গিয়েছে। এরপর বাবা তার মেয়েকে, ঐ কাপের কফি পান করতে দিলে, কফির স্বাদ পেয়ে মেয়েটি হেসে দিয়ে বলল, বাবা এর মানে কি?
বাবা বললেন, দেখো আলু, ডিম এবং কফি প্রত্যেকে একই প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে-সেটা হচ্ছে আগুনে ফুটন্ত পানি। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই ভিন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
পানিতে দেবার আগে আলুগুলো ছিল শক্ত এবং কঠিন, কিন্তু ফুটন্ত পানিতে এই আলু নরম এবং দুর্বল হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে ডিমগুলো ছিল ভঙ্গুর, বাহিরের খোসা সরালেই ডিমের ভিতর ছিল তরল। কিন্তু ফুটন্ত পানিতে ডিমের ভিতরের অংশ নরম থেকে শক্ত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু কফির গুড়ো সম্পুর্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এরা ফুটন্ত পানির সংস্পর্শে এসে পানিকে পরিবর্তন করে নূতন সুস্বাদু পানীয় তৈরি করেছে।
বাবা এবার মেয়েকে বললেন, প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি কি আলু? নাকি ডিম? নাকি কফি?
“প্রতিকূলতা যখন তোমার দরজায় কড়া নাড়ায়, তখন কিভাবে তুমি প্রতিক্রিয়া জানাও, সেটা খুব গুরুত্ত্বপূর্ন। আলুর মত নরম এবং দুর্বল হয়ে পড়ো নাকি ডিমের মত শক্তিশালী হয়ে উঠো নাকি কফির মতো পুরো প্রতিকূলতাকে পরিবর্তন করে সুস্বাদু করে নাও সেটা খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন”
এখন পাঠকদের নিকট আমার প্রশ্ন, আয়ারল্যান্ডে মহামারী নামক প্রতিকূলতা মোকাবেলায় আমরা কি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি? আমরা কি আলুর মত নরম এবং দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম? নাকি ডিমের মত, খোসার ভিতরে শক্ত এবং কঠিন ছিলাম? না কি কফির মত পুরো পানিকে পরিবর্তন করে পুরো প্রতিকুলতাকে সহনীয় করতে পেরেছি?