
আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ ২০২০ ছিল যেন স্বজন হারানোর বছর। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ছিল বছরজুড়ে। অদৃশ্য ভাইরাসের থাবায় সরকারি হিসাবেই প্রাণ গেছে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষের। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যোগ হয়েছেন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। অসংখ্য মানুষ হারিয়েছে স্বজন। দেশ হারিয়েছে প্রথিতযশা শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পপতি, রাজনীতিক, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ পেশাজীবীদের।
করোনাসহ বিভিন্ন কারণে বিদায়ী বছরে মারা গেছেন অনেক বর্ষীয়ান রাজনীতিক। করোনার সম্মুখযোদ্ধা বেশ কয়েকজন চিকিৎসক মারা গেছেন অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে। ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছেন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্য। সব প্রতিকূলতার মধ্যেও মাঠে থেকে মানুষের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী।৮ মার্চ দেশে করোনা শনাক্তের পর ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা মানুষের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। অধিকাংশ মৃত্যুই হয় করোনাভাইরাস সংক্রমণে। এ ছাড়া হৃদ, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সিলেটে গরিবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত ডা. মো. মঈন উদ্দিন মারা যান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। তার আগে ৬ এপ্রিল দুদক পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান করোনায় মারা যান। ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও মৌলভীবাজার মিনিবাস মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সৈয়দ মফচ্ছিল আলী মারা যান করোনা সংক্রমণে। ২২ এপ্রিল মারা যান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন। ২৮ এপ্রিল মারা যান খ্যাতিমান প্রকৌশলী জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা গেলেও পরে করোনা পরীক্ষায় তিনি পজিটিভ হন।
৩ মে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিফ হেমোটোলজিস্ট এবং ল্যাবরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট অধ্যাপক কর্নেল (অব.) মো. মনিরুজ্জামান করোনায় মারা যান। ৫ মে মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী মনসুর উল করিম। ৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. নাজমুল করিম করোনায় মারা যান। ১০ মে করোনায় মারা যান বিএনপি জোট সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আনোয়ারুল কবির তালুকদার। ১২ মে ইবনে সিনার রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মেজর (অব.) আবুল মোকারিম মো. মহসিন উদ্দিন করোনায় মারা যান। ১৪ মে করোনায় মৃত্যু হয় একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের। ভারত সরকারের কাছ থেকেও তিনি পদ্মভূষণ পদক পান। ১৫ মে করোনায় মারা যান টেলিভিশন নৃত্যশিল্পী সংস্থার সাবেক সভাপতি হাসান ইমাম। ২৪ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, সাবেক এমপি হাজী মো. মকবুল হোসেনের। ২৬ মে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুরে এলাহীর স্ত্রী, সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল নিলুফার মঞ্জুর করোনা সংক্রমণে মারা যান। ২৭ মে করোনায় মারা যান সাবেক যুগ্মসচিব, মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক ভূইয়া। ৩১ মে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান, টিভি ব্যক্তিত্ব, নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা ও আবৃত্তিকার মোস্তফা কামাল সৈয়দ ও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক সচিব বজলুল করিম চৌধুরী।

১৩ জুন করোনা সংক্রমণে মারা যান আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি ছিলেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে। ১৪ জুন করোনায় মারা যান ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো. আবদুল্লাহ। ১৫ জুন মারা যান সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। ২০ জুন করোনা সংক্রমণে মৃত্যু হয় বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক কামাল লোহানীর। ২৫ জুন মারা যান ইসলা?মিক ফাউন্ডেশনের সা?বেক মহাপ?রিচালক (ডিজি) সামীম মোহাম্মদ আফজাল।
৬ জুলাই মারা যান প্লেব্যাক সিঙ্গার খ্যাত জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। তিনি দীর্ঘদিন ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ৯ জুলাই থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। ১৩ জুলাই করোনা সংক্রমণে মারা যান চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা উত্তর বিভাগের উপ কমিশনার মো. মিজানুর রহমান। ১৪ জুলাই মারা যান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা পর্বের সাক্ষী, বর্ষীয়ান রাজনীতিক, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজ। ১৭ জুলাই মারা যান বরেণ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। ওই দিনই করোনা সংক্রমণে মারা যান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবদুল হাই। ২৭ জুলাই করোনা সংক্রমণে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা যান নওগাঁ-৬ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলম।
৩ আগস্ট করোনা সংক্রমণে মারা যান বাংলাদেশ টেলিভিশনের খ্যাতিমান প্রযোজক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ। তিনি নন্দিত অভিনেত্রী বিজরী বরকতুল্লাহর বাবা ও নৃত্যশিল্পী জিনাত বরকততুল্লাহর স্বামী। ৯ আগস্ট মারা যান কিংবদন্তি সুরসম্রাট আলাউদ্দিন আলী। ১০ আগস্ট করোনায় মারা যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) কমিউনিটি মেডিসিনের সাবেক অধ্যাপক ডা. মোস্তাক হোসেন আনসারী। ২৫ আগস্ট মারা যান সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত (বীরউত্তম)। ২৩ আগস্ট মারা যান এনটিভির যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক আবদুস শহীদ।
৫ সেপ্টেম্বর করোনা সংক্রমণে মারা যান সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ওসমান চৌধুরী। ১৮ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। ২৭ সেপ্টেম্বর মারা যান অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা জেলহত্যা, সংবিধানের ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনীসহ ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলার শুনানি করেন।
৮ অক্টোবর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২৪ অক্টোবর মারা যান খ্যাতিমান আইনজীবী, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।
১ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সদস্য, সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’ সম্পাদক, বাংলা একাডেমির ফেলো আবুল হাসনাত ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে মারা যান। ১১ নভেম্বর দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিবহন কোম্পানি হানিফ পরিবহনের প্রতিষ্ঠাতা জয়নাল আবেদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৬ নভেম্বর মারা যান জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি, শরীয়তপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত ছয়বারের সংসদ সদস্য, স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) শওকত আলী। ২১ নভেম্বর করোনা সংক্রমণে মারা যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার ঐতিহ্যবাহী দরবারের পীর ও আড়াইবাড়ী ইসলামিয়া সাঈদিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ প্রখ্যাত আলেম দীন মাওলানা গোলাম সারোয়ার সাঈদী। ২৪ নভেম্বর দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার মুনীরুজ্জামান করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২৭ নভেম্বর ক্যান্সার ও করোনা সংক্রমণে মারা যান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের। ২৯ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহা. আবদুল হান্নান খান পিপিএম করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
১০ ডিসেম্বর মারা যান বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সচিব, রাষ্ট্রদূত, মুক্তিযুদ্ধকালীন কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান কর্নেল (অব.) আনোয়ার উল আলম শহীদ। ১৩ ডিসেম্বর দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম হেফাজতে ইসলামের নবনির্বাচিত মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় মারা যান। ২৪ ডিসেম্বর করোনা সংক্রমণে মারা যান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাবেক বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর। ২৬ ডিসেম্বর করোনায় মারা যান জনপ্রিয় অভিনেতা, বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র নিয়মিত শিল্পী আবদুল কাদের। জনপ্রিয় এ অভিনেতা কর্মজীবনে টেনাশিনাস পদক, মহানগরী সাংস্কৃতিক ফোরাম পদক, অগ্রগামী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পদক, জাদুকর পি সি সরকার পদক, টেলিভিশন দর্শক ফোরাম অ্যাওয়ার্ড, মহানগরী অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন পদক পান। ২৯ ডিসেম্বর মারা যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের ভগ্নিপতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আতফুল হাই শিবলী।
এ ছাড়া দৈনিক ভোরের কাগজের সাবেক সহকারী সম্পাদক, এনটিভির সাবেক বার্তা সম্পাদক সুমন মাহমুদ, দৈনিক সময়ের আলোর নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবীর খোকন, ভোরের কাগজের ক্রাইম রিপোর্টার গীতিকার আসলাম রহমান, দৈনিক সময়ের আলোর মাহমুদুল হাকিম অপু, এশিয়ান কারাতে ফেডারেশনের রেফারি, বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের সদস্য ও বাংলাদেশ আনসার কারাতে দলের কোচ হুমায়ুন কবীর জুয়েল, বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শিক্ষাবিদ নজবুল হক, সদ্য অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়া অতিরিক্ত সচিব তৌফিকুল আলম করোনা সংক্রমণে বিদায়ী বছরে মারা যান। করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাবরিনা ইসলাম সুইটির। এ ছাড়া বিদায়ী বছরে এ অদৃশ্য ভাইরাসে আরও অনেক গুণীজন হারিয়েছে দেশ।