রহমান ফাহমিদাঃ ১৯৮১ সালের এক বিকেলে আকাশটা এমন থমথমে হয়ে আছে মনে হচ্ছে কারো সাথে রাগ করে আছে।হয়তো একটু পর রেগেমেগে কেঁদেই ফেলবে,তখন হয়তো অঝর ধারায় বৃষ্টি শুরু হবে পৃথিবীর বুকে।অনামিকার মনটাও আজ আকাশের মতই থমথমে হয়ে আছে।অজানা এক নীল খামের চিঠি অনামিকার এই মন খারাপের কারণ।ভালোই তো চলছিল ওর জীবনের ঘড়িটা।সমবয়সী চাচাতো ভাই আর ওর বন্ধুদের সাথে মাঠেঘাটে,জঙ্গলে ঘুরেফিরে,সেই সাথে মার্বেল,ক্রিকেট,ফুটবল,ডাংগুলি,ঘুড়িউড়ানো কতরকমের খেলা করে। এমনকি নিজের বাসার পেয়ারা,বরই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে খেয়ে,জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে জংলী ফুলের মধু পান করে,সেই সাথে ফড়িং-এর লেজে সুতো বেধে উড়িয়ে খেলা করে ভালই তো ছিল।অনেক সময় বর্ষা কালে বাড়ির উঠোনে পানি জমলে সেই পানিতে কাগজের নৌকা বানিয়ে ছেড়েছে,এভাবেই মজার মজার খেলা করে অনামিকার দিনগুলি চলছিল।হয়তো কারও কুনজরে সেই মজার দিন আর বেশি দিন রইল না।অনামিকা কখনোই ভাবেনি,ও ওর চাচাতো ভাইদের চেয়ে আলাদা!কিন্তু এক নিমিষেই একটি নীল খামের চিঠি ওর জীবনের বাঁকটাকে ঘুরিয়ে দিল এবং ওর ধারণা পাল্টিয়ে দিল!চিঠিটি বুঝিয়ে দিল ও ওর ভাইদের থেকে আলাদা এক স্বত্বা।কারণ ও মেয়ে আর ওরা ছেলে।ওরা যা করতে পারে ও তা করতে পারেনা।এক সময় ওর উড়ন্ত ডানা দুটি কেটে ফেলতে হল সমাজের ভয়ে।ফিরে আসতে হল ঐ বিশাল আকাশের প্রান্তর ছেড়ে পাখির পিঞ্জরের মত ঘরের এক কোণায়।একটি চিঠি ওকে বেধে ফেলল ঘরের চৌকাঠে আর দুরন্ত বাঘিনী ঘরে ফিরে হয়ে গেল মেনিবিড়াল।একদম চুপচাপ আর ঝিম্ মেরে গেল অনামিকা।
একদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বাড়ির কাছেই মাঠে খেলতে গিয়েছিল চাচাতো ভাইদের সাথে।খেলা শেষ করে ঘরে পা রাখতেই মায়ের হুঙ্কার!অনামিকা,এদিকে আয়!অনামিকা মায়ের কাছে গেলে,মা কোনো ভণিতা না করেই সরাসরি অনামিকাকে প্রশ্ন করল,তুই কি কোনো ছেলেকে আমাদের বাসার ঠিকানা দিয়েছিস?অনামিকা মায়ের প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়ল!অনামিকা বল্ল মা,আমার জানা মতে আমি কাউকে আমাদের ঠিকানা দেই নাই।মা বল্ল,ঠিকানা যদি না দিস তবে এই ছেলে কি করে তোর নামে আমাদের ঠিকানায় চিঠি পাঠালো?অনামিকা মায়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল!বলল,মা তুমি এসব কি বলছো?কোন্ ছেলে আমাকে চিঠি পাঠিয়েছে?বিশ্বাস কর মা,আমি কিছু জানিনা!মা,নীল একটি খাম অনামিকার হাতে ধরিয়ে দিল।মা,চিঠিটি খুলেনি কারণ অনামিকাদের বাসার নিয়ম,কেউ কারো চিঠি পত্র কাউকে না জিজ্ঞেস করে খুলেনা।অনামিকা নিজের ঘরে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটি খুলে পড়ল।চিঠির মধ্যে গোলাপের পাপড়ি দেয়া যার ফলে চিঠিটি খোলা মাত্রই ঝুরঝুর করে পাপড়িগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল আর একটা মিষ্টি সুবাস ঘরের মধ্যে ভরে গেল।অনামিকে চিঠিতে কি লেখা আছে তা পড়ল।চিঠিতে লেখা আছে-
“হাই আমি মারুফ।আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।তুমি হয়তো ভাবছো আমি তোমার ঠিকানা কোথায় পেলাম আর তোমাকে আমি কেন তুমি তুমি করে বলছি!এবার পয়েন্টে আসি,আমি তোমার ঠিকানা কাগজওয়ালার ঝুড়িতে(মানে বাসায় বাসায় গিয়ে যে কাগজ কিনে নিয়ে যায় সেই ফেরিওয়ালা)একটি বই থেকে পেয়েছি তবে বইটি অষ্টম শ্রেণীর একটি মেয়ের নাম,তার রোল,স্কুলের নাম লেখা ছিল।যেহেতু সে নতুন ক্লাসে উঠেছে তাই অষ্টম শ্রেণীর বইগুলো বিক্রি করে দিয়েছে আর আমি ভাগ্যক্রমে তোমার ঠিকানা পেয়ে গেলাম।হয়তো মেয়েটি তোমার বান্ধবী হতে পারে!এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো,আমি কেন তোমাকে তুমি বলছি?কারণ তুমি আমার চেয়ে ছোট।যাই হোক তোমার নামটি এত সুন্দর,”অনামিকা”তাই তোমাকে না দেখেই বুঝতে পারছি তুমি অনেক সুন্দর!সেই জন্য প্রথমেই তোমার নামটির প্রেমে পড়ে গিয়েছি। তাই সাহস নিয়ে তোমাকে চিঠি লিখেই ফেল্লাম।আশা করি তুমি আমাকে নিরাশ করবেনা!আপাততঃ আমি আমার এক বন্ধুর ঠিকানা দিলাম।এই ঠিকানায় চিঠি দিও।আমি তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকবো।ভয় পাওয়ার কিছু নেই,আমার ঐ বন্ধুকে কিছুই বলিনি।আমি তোমার অনামিকায় আংটি পড়াতে চাই।তুমি চিঠি পাঠালেই আমি বুঝবো,তুমি আমার সাথে সম্পর্ক করতে রাজী আছো।প্লিজ,কিছু একটা লিখে পাঠাও,আমার খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখতে।অনেক অনেক ভালোবাসা তোমার জন্য।
ইতি, তোমারই মারুফ”।
অনামিকা পুরো চিঠি পড়ে কেঁদে ফেলল।অনামিকার মা,অনামিকার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ওর ঘরে এসে দেখল ও কাঁদছে!মা ওর কাছে গিয়ে ওর মাথায় যেইনা হাত রেখেছে আর অনামিকা তখন মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মা বুঝল,অনামিকা কিছুই জানেনা।মা, চিঠিটি নিয়ে পড়ে দেখল ছেলেটি যে ঠিকানা দিয়েছে তা অনামিকার নানার বাড়ির কাছেই।মা,অনামিকাকে বল্ল,সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে,হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে পড়তে বস।আমি চিঠিটি নিয়ে গেলাম।তুই এগুলো মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেল্। অনামিকার কিছুই ভালো লাগছেনা!অনামিকার মনে হল ও’ হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করল সব মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে কিন্তু বারবার চিঠিটি ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রাতে অনামিকার মামা ওদের বাসায় আসল। অনামিকার মা মামাকে ছেলেটির চিঠির কথা জানালো আর বলল ছেলেটি যে ঠিকানা দিয়েছে তা খোঁজ করে ছেলেটির খবর নিতে,কেন ছেলেটি অনামিকাকে চিঠি পাঠিয়েছে? অনামিকার মামা বলল এরকম করা ঠিক হবেনা বরং হিতেবিপরীত হবে,তার চেয়ে পাত্তা না দিলে এখানেই ব্যাপারটা থেমে যাবে।তাছাড়া অনামিকা এখন বড় হচ্ছে এরকম অনেক চিঠি আর ফোন কল আসবে,এসব পাত্তা দিলে বরং অশান্তি বাড়বে।এখন তো পত্রমিতালির যুগ,তাই পত্র দিয়ে বিরক্ত তো করবেই!তার চেয়ে সব কিছু স্বাভাবিকভাবে নিলেই হয়।মামা ডিনার করে চলে গেলে সবাই যার যার রুমে ঘুমাতে গেল কিন্তু অনামিকার চোখে ঘুম এলোনা।সারা রাত শুধু চিঠির কথা মনে হল সেই সাথে ছেলেটির কথা!যদিও ও’ছেলেটির কিছুই জানেনা,যতটুকু চিঠিতে লেখা ছিল সেটুকু ছাড়া।মনে হচ্ছিল চিঠিটি আবার পড়তে কিন্তু তা সম্ভব না,চিঠিটি মায়ের কাছে।জীবনের প্রথম ভালোবাসার চিঠি পেয়ে অনামিকার কেমন যেন একটা কষ্ট কষ্ট অনুভুতি হচ্ছে বুকের ভেতর।ছেলেটিকে চেনেনা জানেনা তবুও কেন ছেলেটির একটি ছায়া ওর চোখের সামনে এসে ধরা দিচ্ছে,এ কেমন ভালোবাসার বিড়ম্বনা!