আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে যে দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত করা সর্বশেষ নূতন ধরনের কোভিড-১৯ ভাইরাস "উদ্বেগের ধরন" (VARIETY OF CONCERN) হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। কোভিডের নূতন ধরনের এই ভাইরাসের নাম দেয়া হয়েছে "অমিক্রন" যার আসল নাম বি ১. ১. ৫২৯। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে কোভিডের নূতন এই ধরন অন্যান্য ধরনের তুলনায় পুনরায় সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকি বহন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার-প্রযুক্তিগত প্রধান, ডাঃ মারিয়া ভ্যান কেরখোভ বলেছেন যে অমিক্রনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মিউটেশন রয়েছে, যার মধ্যে কিছু উদ্বেগজনক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাধারণত ভাইরাসকে ৪টি ভাগে বিভক্ত করে থাকে। ধরন গুলো হচ্ছে "উদ্বেগের ধরন (VARIETY OF CONCERN), আগ্রহের ধরন (VARIANT OF INTEREST), আর মনিটর করা হচ্ছে (VARIANT UNDER MONITORING)। এই তিন ধরনের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিলো আলফা, বেটা, গামা এবং ডেল্টা। আমরা দেখেছি সর্বশেষ ডেল্টা ধরনের সংক্রমণের কারণে এখনো বিশ্বব্যাপী মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, এর সাথে আজ আরেকটি নূতন ধরন "অমিক্রন" সকলের চিন্তা এবং উদ্বেগকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইতোমধ্যে জার্মানি, ইতালি ও ব্রিটেনের সরকার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে। করোনার নতুন ধরনটির সংক্রমণ প্রতিরোধে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ডেল্টার আগেও দক্ষিণ আফ্রিকায় মিউটেশন হওয়া “বেটা” ধরন বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চাপে ফেলেছিল।
নতুন ধরন পাওয়ার পর নতুন করোনা রোধে আফ্রিকার দেশগুলো থেকে বিমান উড়ানো বন্ধের প্রস্তাব করতে যাচ্ছে ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন। ইতোমধ্যে শুক্রবার নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জার্মানিতে কার্যকর হয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আশপাশের দেশগুলো থেকে ভ্রমণ করলে টিকা নেয়া থাকলেও ন্যূনতম ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন করতে হবে। ব্রিটেনও শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দেশগুলোয় থেকে বিমান ভ্রমণ বাতিল করেছে।
শুক্রবার পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার গৌতেং প্রদেশে ৭৭ জনের দেহে এই ধরনটি পাওয়া গেছে, এর বাইরে বতসোয়ানায় ৪জন ও হংকংয়ে ১ জনের দেহে এ ধরন শনাক্ত হয়েছে, তারাও মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যাওয়া। ধরনটি বেশ দ্রুতগতিতে ছড়ায় বলে প্রাথমিকভাবে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ধরনটি করোনার প্রচলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও ফাঁকি দিতে সক্ষম বলে মনে করা হচ্ছে।
নতুন ধরনের সন্ধান পাওয়ার মধ্যে বাংলাদেশে গত ২৫ নবেম্বর করোনায় মৃত্যু বাড়লেও শনাক্তের সংখ্যা কমেছে। বৃহস্পতিবারে নতুন করে মোট ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে একই সময়ে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা কমেছে। আলোচিত সময়ে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৩৭ জনের।
সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড নিয়ন্ত্রণে থাকলেও স্বস্তিতে ভুগে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে আবার বিপর্যয় আসতে সময় লাগবে না বলে সতর্ক করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে এর নমুনা দেখা যাচ্ছে। তারা বলছেন, সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসায় মানুষের মনে দেশে করোনা নেই ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে সময় নেবে না। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আবারও চিত্র বদলে যেতে পারে। এর আগে ২৯ অক্টোবর ৩০৫ জন শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিল অধিদফতর। এরপর থেকে দৈনিক শনাক্ত ছিল ৩০০’র কম।
এদিকে, মহামারীকালে গত ২০ নবেম্বর প্রায় ২০ মাস পর করোনায় দেশের কেউ মারা যাননি। তবে এর ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর ২১ নবেম্বর একদিনে সাতজনের মৃত্যুর কথা জানায় অধিদফতর। তার পরদিন ২ জনের মৃত্যু হয়। পরের দুদিন তিনজন করে মৃত্যুর কথা জানানো হয়। অধিদফতরের তথ্যমতে, ২৪-২৫ নবেম্বর রোগী শনাক্তের হার ছিল এক দশমিক ২৫ শতাংশ। ১৬ অক্টোবর চলতি বছরে প্রথমদিনের মতো শনাক্তের হার দুই এর নিচে নেমে আসে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সংক্রমণ কমায় স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলেঢালা ভাব এসেছে। মানুষ মাস্ক পরছে না। শপিংমল, গণপরিবহন, বেসরকারী অফিস, রেস্তরাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে অভিভাবকদের ভিড় দেখা যাচ্ছে। হাসপাতালেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গত ৬ই জুলাই দেশে দৈনিক শনাক্তর সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। অতি সংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবে জুলাই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাস। এ মাসের প্রায় প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যুতে আগের দিনের রেকর্ড ভাঙ্গতে থাকে। এরইমধ্যে করোনাকালে গত ২৮শে জুলাই একদিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয় ১৬ হাজার ২৩০ জন। শনাক্তের হার উঠে যায় ৩২ শতাংশের বেশি। ভয়ানক জুলাইয়ের রেশ চলে আগস্ট পর্যন্ত।
১২ই আগস্ট পর্যন্ত ৩৮ দিনের মধ্যে ৩০ দিনই শনাক্ত ছিল ১০ হাজারের বেশি। আর করোনাকালে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় আগস্টের দুদিন। ৫ ও ১০ই আগস্ট একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যুর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সংক্রমণ কমে আসায় সরকার কঠোর বিধি-নিষেধ তুলে দেয়। খুলে দেয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখন কোনও দিন শনাক্তের হার থাকছে ১ শতাংশের কিছু বেশি। এ পরিস্থিতিতে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে স্বাস্থ্যবিধি না মানার পাশাপাশি বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি সে শঙ্কাকে আরও উদ্বেগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যে কোনও সময় সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে মহামারী বিশেষজ্ঞ ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, নতুন ধরন ডেল্টার চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। এরমধ্যে আফ্রিকান দেশগুলোতে নতুন ধরনের সন্ধান মিলেছে। যেগুলোর স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে আগের করোনার স্পাইক প্রোটিনের কোন মিল নেই। ইউরোপের দেশগুলোতে আরও নতুন নতুন ধরনের আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্লাইট চালু হয়েছে। নজরদারি বাড়াতে হবে, রোগী ব্যবস্থাপনা বাড়াতে হবে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন যত রোগী শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, আইসোলেশন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিন হচ্ছে কিনা দেখতে হবে।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শেয়ারবাজারের পতনের পর আশংকাকে সত্যি করে শুক্রবার সকালে বিপুল পতন হলো ভারতের শেয়ারবাজারে। সেনসেক্স পড়ল প্রায় এক হাজার ৪০০ পয়েন্ট। প্রায় ৪০০ পয়েন্ট নামল নিফটিও। শুক্রবার সকাল ১১টায় সেনসেক্স নেমে যায় ১৪০৮ পয়েন্ট। পরে তা সামান্য বাড়লেও বাজারের তেমন একটা উন্নতি হয়নি। এই বিপুল পতনের ফলে বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়।
তথ্য সূত্রঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আর টি ই, সিডিসি, আল জাজিরা, দৈনিক জনকণ্ঠ