আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর উপর রমজানের রোজা ফরজ করেছেন। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম একটি হলো রমজান মাসের রোজা।
ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক সুস্থ ও বিবেকসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমজান মাসের প্রতিদিন রোজা রাখা ফরজ বা অবশ্যপালনীয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে মুসলিম জাতির উপর রোজা ফরজ করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারো।’
হিজজি শাবান মাসের ১০ তারিখে উক্ত আয়াতটি আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় হাবিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর নাজিল করেন এবং মুসলমানদের উপর রোজা ফরজ হয়।
কিন্তু মাঝে মধ্যে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে; ইসলামের পূর্বে রোজা কেমন ছিল? কবে প্রথম এই মাসব্যাপী রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়?
রোজা রাখার নিয়ম সর্বযুগেই প্রচলিত ছিল। আদি মানব সর্বপ্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত নবী-রাসূলরা রোজা পালন করেছেন।
রোজা শুধু রাসূলে করিম (সা.) এর প্রতি ফরজ করা হয়নি, পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের প্রতিও ফরজ করা হয়েছিল। হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত নূহ (আ.) পর্যন্ত চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা ফরজ ছিল, যাকে ‘আইয়্যামে বিজ’ বলা হতো।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোজা রাখার বিধান ছিল। পরে দ্বিতীয় হিজরি সালে উম্মতে মুহাম্মদির উপর মাহে রমজানের রোজা ফরজ হলে তা রহিত হয়ে যায়।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিন সাওম পালন করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? তোমরা এই দিনে সাওম পালন কর কেন? তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহতায়ালা বনি ইসরাইলকে শত্রুর কবল থেকে নাজাত দান করেছেন। তাই হজরত মূসা (আ.) এ দিনে সাওম পালন করেছেন।
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসা (আ.) এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিন সাওম পালন করেন এবং সবাইকে সাওম পালনের নির্দেশ দেন।
বিভিন্ন ধর্মে রোজার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, চীন, জাপান, কোরিয়া, মিসর ও গ্রিসে রোজার প্রচলন ছিল।
হজরত মূসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছ থেকে তাওরাত প্রাপ্তির আগে ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করেছিলেন। হজরত ঈসা (আ.) তার ধর্ম প্রচারের শুরুতে ইঞ্জিল পাওয়ার আগে ৪০ দিন রোজা রেখেছিলেন।
হজরত মূসা (আ.), হজরত ঈসা (আ.) এবং তাদের অনুসারীরা সবাই রোজা পালন করেছেন। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের জন্য রোজা পালনের বিধান ছিল। ইহুদিদের ওপর প্রতি শনিবার বছরের মধ্যে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন এবং অন্যান্য সময় রোজা ফরজ ছিল।
খ্রিষ্টানদের ওপর মুসলমানদের মতো রোজা ফরজ ছিল। বাইবেলে রোজাব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার মধ্যেই রোজা পালনের ইতিহাস পাওয়া যায়।
‘রমজান’ শব্দটি আরবি ধাতু রামিয়া বা আর-রামম থেকে উদ্ভূত যার অর্থ ‘তাপমাত্রা,’ বা ‘শুষ্কতা’। অ-আরবীয় মুসলিম দেশ যেমন ইরান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং তুরস্ক এটিকে ‘রামাজান’ বা ‘রমজান হিসাবে উল্লেখ করা হয়। কারণ আরবী বর্ণ ‘ض’ তাদের বর্ণের জন্য ‘জ’ উচ্চারণ তৈরি করে।
আরবি হিজরি ক্যালেন্ডারের নবম মাস হলো রমজান। ৬১০ সালের রমজান মাসেই হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ওহির মাধ্যমে নবুয়ত পেয়েছিলেন।
এ মাসের যে রাত্রিতে প্রথম আয়াতগুলো নাজিল হয় (সূরা আলাক এর প্রথম পাঁচ আয়াত) সে রাতকে বলা হয় শবে কদর বা লাইলাতুল কদর।
বলা হয়েছে যে, রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাত্রির কোনো এক রাত্রি এই শবে কদর, প্রসিদ্ধমতে সেটা ২৭ তারিখ ধরে নেয়া হয়। যদিও আরেক মতে সেটি ২৩তম রাত্রি। তবে নিশ্চিতভাবে এই রাতটি পাবার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ ইতিকাফ করে থাকেন, অর্থাৎ নির্জনে টানা ১০ দিন ইবাদত। আর এই রমজান শেষ হওয়া মানেই ঈদুল ফিতর যা মুসলিমদের প্রধান দুটি উৎসবের একটি।
পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও, মতবাদ আছে যে, নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর সহিফা নাজিল হয়েছিল তৎকালীন রমজানের ১ম দিবসে, তাওরাত এসেছিল ৬ রমজান, যাবুর ১২ রমজান আর ইঞ্জিল ১৩ রমজান। যদিও আরবের বাইরে রমজান মাস হিসেব করা হতো না, কিন্তু এই হিসেবটা ভিন্নজাতিক ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মিলিয়ে স্থির করা হয়েছে বলে বলা হয়।
তবে পুরো এক মাস পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার আদেশ অবতীর্ণ হয় যখন হজরত মুহাম্মাদ (সা) এবং সাহাবিরা মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করেন তার পরে। সেটা ছিল হিজরতেরও ১৮ মাস পরের ঘটনা। তখন আরবি শাবান মাস চলছিল।
তবে এমন না যে, এর আগে কেউ রোজা রাখত না। অবশ্যই রাখত। কোরআনেই বলা রয়েছে যে, আগের জাতিগুলোর জন্যও রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, সেটা রমজান না হলেও।
যেমন- মক্কার মানুষেরাও ইসলামের পূর্বে রোজা রাখত, তবে সেটা কেবল মুহাররম মাসের ১০ম দিন, আশুরার রোজা। কারবালার ঘটনা তখনও ঘটেনি, আশুরার প্রধান উপজীব্য ছিল হজরত মুসা (আ) এর নেতৃত্বে মিসর থেকে বনী ইসরাইলের মুক্তি এবং লোহিত সাগর দু’ভাগ হয়ে যাবার ঘটনা। আত্মসংযম আর আল্লাহ্র সন্তুষ্টির নিমিত্তে অন্যরাও রোজা রাখত বটে।
৭৪৭ সালের একজন আরব লেখক আবু যানাদ জানান যে, উত্তর ইরাকের আল জাজিরা অঞ্চলে অন্তত একটি মান্দাইন সমাজ ইসলাম গ্রহণের আগেও রমজানে রোজা রাখত।
প্রথম থেকেই রমজানের রোজা রাখা শুরু হত নতুন চাঁদ দেখবার মাধ্যমে, তাই অঞ্চল ভেদে রোজার শুরুও ভিন্ন হতো। এখন মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি দেশের মুসলিমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক সময়ানুসারে সেখানে রোজা রাখতে পারে না, যেহেতু সেখানে দিনরাত্রির পার্থক্য করা দুরূহ। তাই নিকটতম স্বাভাবিক দেশের সময়সূচী কিংবা মক্কার সময় মেনে তারা রোজা রাখে এবং ভাঙে।
অতিরিক্ত ইবাদত হিসেবে রয়েছে তারাবি, যদিও সেটি বাধ্যতামূলক নয়, বরং সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) প্রথমদিকে জামাতের সঙ্গে সে নামাজ আদায় করলেও পরে জামাতে করেন নি, পাছে সেটি মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। তবে খলিফা উমর (রা.) পুনরায় জামাতে আদায় করা শুরু করেন তার শাসনামলে।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, হজরত মূসা ও হজরত ঈসা (আ.) এবং তাদের উম্মাতগণ সবাই সাওম পালন করেছেন। নবীগণের মধ্যে হজরত দাউদ (আ.)এর রোজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইব্নুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সবসময় রোজা রাখ এবং রাতভর নামাজ আদায় কর। আমি বললাম জী, হ্যাঁ! তিনি বললেন, তুমি এরূপ করলে তোমার চোখ বসে যাবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। যে ব্যক্তি সারা বছর রোজা রাখল সে যেন রোজাই রাখল না। (প্রতি মাসে) তিনদিন রোজা রাখা সারা বছর রোজা রাখার সমতুল্য।
আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশি রাখার সামর্থ রাখি। তিনি বললেন: তাহলে তুমি ‘সাওমে দাউদী’ পালন কর। তিনি একদিন রোজা রাখতেন আর একদিন ছেড়ে দিতেন। ( ফলে তিনি দূর্বল হতেন না ) এবং যখন তিনি শত্রুর সম্মুখীন হতেন তখন পলায়ন করতেন না।
এতে প্রমাণিত হয় যে, হজরত দাউদও (আ.) সিয়াম পালন করেছেন। মোটকথা হজরত আদম (আ.) এর যুগ থেকেই রোজা রাখার বিধান ছিল।