শফিকুল ইসলামঃ দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে জুতা, হালকা প্রকৌশল, প্লাস্টিক পণ্যের রফতানি বাড়ানোর কথাও ভাবছে সরকার। এসব পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী সংস্থাগুলোতে নতুন উৎপাদন তৈরির বিষয়টিও সরকার বিবেচনা করছে। এ লক্ষ্যে ‘এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস (দ্বিতীয় সংশোধন)’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের রফতানি বহুমুখীকরণ ও রফতানি প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করার লক্ষ্যে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাদুকা, হালকা প্রকৌশল, প্লাস্টিক পণ্যের লক্ষ্যযুক্ত খাতের পণ্য রফতানি, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রবেশ এবং রফতানি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রবেশের পথে যে সবসমস্যা রয়েছে তা দূরীকরণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিলো ৯৪১ কোটি টাকা। প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছিলো এক হাজার ১২ কোটি ১২ লাখ টাকা। প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীতে (প্রস্তাবিত) এর ব্যয় আরও বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ১০৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১৭২ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং প্রকল্প ঋণ বাবদ ৯৩৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা যোগান দেওয়া হবে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে (প্রস্তাবিত) জুলাই ২০১৭ শুরু হওয়া প্রকল্পটি জুন ২০২৫ নাগাদ বাস্তবায়িত হবে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের আটটি বিভাগের ২৪টি জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। লক্ষ্যযুক্ত খাতে রফতানি বৃদ্ধি করা (চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য/জুতা/হালকা প্রকৌশল/প্লাস্টিক) এবং সুবিধাভোগী সংস্থাগুলোতে নতুন উৎপাদন তৈরি করাই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত প্রস্তাবনায় এ প্রকল্পের আওতায় দুটি কম্পোনেন্ট প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে কম্পোনেন্ট-১ হচ্ছে- মার্কেট এক্সেস সাপোর্ট প্রোগ্রামের আওতায় এনভারমেন্টাল, সোস্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটি সহায়িকা তৈরি ও সচেতনতা বাড়ানো। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, প্লাস্টিক এবং হালকা প্রকৌশল খাতের কারখানা পর্যায়ে এনভারমেন্টাল, সোস্যাল এন্ড কোয়ালিটি কমপ্লায়েন্স এসেসমেন্ট বাড়ানো হবে।
এক্সপোর্ট রেডিন্যাস ফান্ড (ইআরএফ) কর্মসূচির আওতায় নির্বাচিত চারটি সেক্টরের ১১০টি কারখানার মানোন্নয়নে ও এনভারমেন্টাল, সোস্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটি কমপ্লায়েন্স অর্জনে বিনিয়োগ সহায়তা করা হবে। মেডিক্যাল অ্যান্ড পারসোনাল প্রোডাক্টিভ ইক্যুয়িপমেন্ট (এমপিপিই) – বিনিয়োগে সহায়তা দেওয়া হবে। মার্কেট ইন্টেলিজেন্স ও মার্কেট লিংকেজ কার্যক্রম এবং রফতানি বাজার সম্প্রসারণে ব্রান্ডিং ও সোর্সিং শো আয়োজন করা হবে।
কম্পোনেন্ট- ২ এ প্রোডাক্টিভিটি এনহান্সমেন্ট প্রোগামের আওতায় দুটি টেকনোলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে। টেকনোলজি সেন্টারের নির্মাণের জন্য ৩০ দশমিক ২০ একর জমি অধিগ্রহণ বা লিজ গ্রহণ করা হবে। চারটি টেকনোলজি সেন্টারের ডিজাইন-ড্রইং, বিল অফ কোয়ান্টিটিস সম্পন্ন করা হবে। দুটি টেকনোলজি সেন্টারের মূল ভবন, হোস্টেল, ডরমেটরি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। টেকনোলজি রোড ম্যাপ প্রস্তুত, প্রয়োজনীয় টেকনোলজি ও মেশিনারিজ টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন, বিল অব কোয়ান্টিটিস ও টেন্ডার ডকুমেন্ট চূড়ান্ত করা হবে।
দুটি টেকনোলজি সেন্টারের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির কমন ফ্যাসিলিটিস সেন্টার ভবনের ভার্টিক্যাল সম্প্রসারণ (পঞ্চম-ষষ্ঠ তলা) সহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামোগত সুবিধা নির্মাণ করা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক টেন্ডার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করার পর অনুমোদিত প্রকল্পের সংস্থানের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলন, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারিজনিত সংক্রমণ ও বিধি নিষেধের কারণে মার্চ ২০২০ থেকে শিল্পকারখানা পর্যায়ের বিভিন্ন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হওয়া, বিদ্যমান বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয় পরিবর্তন, অঙ্গ অন্তর্ভুক্তি বা বাদ, সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সুপারিশের আলোকে চারটি টেকনোলজি সেন্টারের জন্য ২২ একর জমির পরিবর্তে ৩০ দশমিক ২০ একর জমি লিজ বা অধিগ্রহণ বাবদ ছয় কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো এবং একটি টেকনোলজি সেন্টারের স্থান পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পটিতে সংশোধনী আনা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরের আরএডিপিতে প্রকল্পটি ‘এ’ ক্যাটাগরিতে কিছু টাকা বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কমিশন সূত্র আরও জানায়, সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে এই প্রকল্পটি সঙ্গতিপূর্ণ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপি-তে শিল্পখাতের অবদান ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের মধ্যে ৪২ শতাংশ এ উন্নীত করা, শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পণ্যের উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি, শ্রমঘন শিল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন, শিল্প উৎপাদনে বেসরকারি খাতের প্রসার, উৎপাদন বহুমুখীকরণ এবং শিল্প উৎপাদনে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, শিল্পায়ন বৃদ্ধি এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
একনেকে অনুমতির সুপারিশ করে পরিকল্পনা কমিশনের মতামতে বলা হয়েছে, রফতানি বহুমুখীকরণ ও রফতানি প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করার লক্ষ্যে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাদুকা, হালকা প্রকৌশল, (ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রোনিক্সসহ) প্লাস্টিক পণ্যের লক্ষ্যযুক্ত খাতে রফতানি বাড়ানো, রফতানির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রবেশ এবং সেখানে প্রবেশের পথে যেসব সমস্যা রয়েছে তা দূরীকরণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রকল্পটি গত ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, সরকার দেশের রফতানি বহুমুখীকরণ ও রফতানি প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করতে চায়। এ লক্ষ্যে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাদুকা বা জুতা, হালকা প্রকৌশল, প্লাস্টিক পণ্য রফতানির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রবেশ এবং এ বিষয়ে যেসব সমস্যা রয়েছে তা দূরীকরণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।