কোটা সংস্কার আন্দোলনে হামলা-সংঘর্ষে নিহত ১৯ঃ উত্তাল বাংলাদেশ

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ কোটা সংস্কার নিয়ে সংঘর্ষে বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) আরও ১২ জন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে রাজধানী ঢাকায় ৯ জন, সাভারে ১ জন, মাদারীপুরে ১ জন এবং নরসিংদীতে ১ জন নিহত হয়েছেন।

এর আগে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কার নিয়ে সংঘর্ষে ৭ শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। এ নিয়ে এ পর্যন্ত কোটা নিয়ে সংঘর্ষে সারাদেশে কমপক্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হলো।

নিহতদের মধ্যে চারজনের মরদেহ রয়েছে রাজধানীর উত্তরার বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে৷ হাসপাতালটির পরিচালক মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, চারজনের মধ্যে দুজন শিক্ষার্থী৷ অন্য দুজনের পরিচয় সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পারেনি৷

এর আগে উত্তরায় পুলিশ ও র‍্যাবের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে দুজন নিহতের খবর পাওয়া যায়৷ তাদের একজন উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান এবং আরেকজন উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মারা গেছেন৷ দুই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন৷
সব মিলিয়ে উত্তরায় ছয়জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে হাসপাতাল সূত্রে। এ ছাড়া ধানমণ্ডিতে সংঘর্ষে ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থী, রামপুরায় এক পথচারী, যাত্রাবাড়ীতে এক রিকশাচালক, সাভারে এক শিক্ষার্থী ও মাদারীপুরে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

আলোচনায় সম্মত সরকার, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, এই আলোচনার জন্য দুজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

আনিসুল হক বলেন, ‘‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখনই আলোচনায় বসতে রাজি হবেন, তখন এ আলোচনা হবে।’’ তিনি জানান, তাকে ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এদিকে শিক্ষামন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, আজ বিকেলেই বৈঠকটি হতে পারে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে গত মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। এ ব্যাপারে হাইকোর্টের বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানকে দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী।

অন্যদিকে কোটা নিয়ে আপিল বিভাগে আগামী ৭ আগস্ট শুনানির দিন নির্ধারিত আছে। শুনানির সময় এগিয়ে আনার জন্য আগামী রোববার আদালতে সরকারপক্ষ আবেদন করবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ডাকে দেশজুড়ে চলছে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি৷ এতে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে৷ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনরতদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে৷

‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ-বিজিবি-র‍্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন পালন করছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা৷

হাসপাতাল, সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য জরুরি সেবা ছাড়া এই কর্মসূচি চলাকালে সব কিছু বন্ধ থাকবে জানিয়েছেন তারা৷

ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ

রাজধানীর শনির আখড়া, কাজলা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর-১০, রামপুরা এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে৷

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শনির আখড়া থেকে মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ীর দিকে আসার চেষ্টা করলে আন্দোলনরতদের ঠেকাতে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়েন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা৷ এরপর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়৷

বেলা সোয়া ১১টার দিকেও যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ আন্দোলনরতরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়ে পুলিশ৷ শনির আখড়ার কাজলা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পুরো সড়কে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে৷

কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের সতর্ক অবস্থান৷
টিয়ারশেল ছোঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে পুলিশ৷ছবি: Rajib Dhar/AP/picture alliance

রাজধানীর মিরপুর-১০ এলাকায় থেমে থেমে পুলিশ ও কোটা আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে৷ মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর ও আশপাশের এলাকায় এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে৷ পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা গোলচত্বরে অবস্থান নিয়েছেন৷ আর আন্দোলনরতদের অবস্থান গোলচত্বরের পাশে আল-হেলাল হাসপাতালের সামনে৷ আর একটি অংশের অবস্থান মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামের দিকে৷

পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করছে৷ এর আগে ব্যাপকভাবে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়েছে৷

রামপুরায় আন্দোলনরত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে৷ এ সময় একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে ভাঙচুর করে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে৷

বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহা জানান, এ সময় ওই এলাকায় ১০-১২টি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে৷

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কয়েকশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সামনে রাস্তায় নেমে আসে৷ পুলিশ তাদের বাধা দিতে গেলে সংঘর্ষ বেধে যায়৷ শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে পুলিশ সদস্যদের ধাওয়া দেন।

এই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত৷ সেখানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে যোগ দেন৷

এসময় শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ এবং তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে পুলিশ৷

এ সময় মেরুল বাড্ডা এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়৷ বেলা ১১টার দিকে পুলিশ ক্যানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে যায়। বাইরে ছিলেন শিক্ষার্থীরা৷ এ সময় সেখানকার বেশ কয়েকটি দোকানপাট, স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়৷

বেলা একটার আগে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে আন্দোলনরতদের দিকে রাবার বুলেট ও ছররা গুলি ছোঁড়ে৷ এ সময় শিক্ষার্থীসহ অনেকে আহত হয়েছেন৷

চট্টগ্রামেও সংঘর্ষ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর উত্তর প্রান্তে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটনা ঘটেছে৷ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ সড়কে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে গেলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়৷ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে এ সময় পুলিশ টিয়ার শেল ও মুহুর্মুহু রাবার বুলেট ছোড়ে।

এর আগে সকাল ১০টার দিকে নগরীর এই প্রবেশ মুখে অবস্থান নেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা৷ এতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আঞ্চলিক সড়কের এই অংশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়৷ চট্টগ্রাম নগরী থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোতে এবং কক্সবাজারগামী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে৷ অন্য প্রান্ত থেকে আসা যানবাহন সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে আটকা পড়েছিল৷

এছাড়াও নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, বগুড়া, মানিকগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে৷

মানিকগঞ্জে খালপাড় এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে৷ এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ পাঁচটি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে৷

দাবি আদায়ে রংপুরের রংপুর জিলা স্কুলের সামনে ও নোয়াখালীতে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে আন্দোলনকারীরা৷

কোটা সংস্কারা আন্দোলনকারীদের একাংশ৷
আন্দোলনরতের উপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ৷ছবি: Zabed Hasnain Chowdhury/IMAGO/SOPA Images

মাঠে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি

কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকাসহ সারা দেশে ২২৯ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে৷ এছাড়াও পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের সতর্ক উপস্থিতি রয়েছে দেশজুড়ে৷

সড়কপথে বিচ্ছিন্ন ঢাকা

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি৷ অন্যান্য জেলা থেকেও আসছে না কোনো বাস৷

গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের বিভিন্ন কাউন্টারের স্টাফ দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, মালিকেরা বাস চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷

হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টার মাস্টার মোহাম্মদ পাপ্পু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘‘টার্মিনালে যাত্রীর সংখ্যা খুব কম থাকায় আমরা বাস ছাড়িনি৷”

সকাল থেকেই যাত্রীর অভাবে ফাঁকা ছিল টার্মিনালের প্রায় সব টিকিট কাউন্টার৷  টার্মিনালের অনেক বাস কাউন্টার ছিল বন্ধ দেখা গেছে৷ সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে বাসগুলো।

এমন দৃশ্য ছিল নগরীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাস টার্মিনালগুলোতেও৷

বিঘ্নিত মোবাইল ইন্টারনেট সেবা

বুধবার রাত থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের ফোর-জি সেবা বন্ধ রয়েছে৷তবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু আছে৷ আর মোবাইল ইন্টারনেটের টু-জি সেবাটি অবশ্য চালু আছে৷ সংশ্লিষ্ট অপারেটরের বরাত দিয়ে দ্য ডেইলি স্টার এ খবর প্রকাশ করেছে৷

মোবাইল ইন্টারনেটের ফোর-জি সেবা বন্ধ রাখায় ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারছেন না ব্যবহারকারীরা৷ বিষয়টি নিয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি)৷ সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি৷

SHARE THIS ARTICLE