মুফতী খন্দকার আজিজুল হক ইয়াকুুবী ।। সমাজ জীবনের প্রথম ভিত্তিই হলো পরিবার। পরিবার বলতে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, ভাইবোনদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একান্নভুক্ত পরিমণ্ডলকে বোঝায়। এদের সমন্বয়ে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব অত্যধিক। মহান আল্লাহ তায়ালার হিকমত যে, তিনি আদি পিতা হজরত আদম আ. ও আদি মাতা হাওয়ার আ. এর মাধ্যমে পৃথিবীতে পারিবারিক জীবনের সূচনা করেছিলেন, যা আজও বিদ্যমান।
পরিবার ও সমাজ ছাড়া নিজে একাকী বসবাস কষ্টকর ও বলতে গেলে অসম্ভব। ছোট থেকে যুব ও পরিণত বয়সে সুখ-দুঃখ, মায়া-মমতা, সেবা-শুশ্রূষাসহ সব কার্যক্রম পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। সুশৃঙ্খল ও স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহের জন্য প্রয়োজন পবিত্র ও সুসভ্য সামাজিক ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থার মধ্যে থাকা চাই পরিপূর্ণ ও সব পর্যায়ে মঙ্গলকর নির্দেশনা। এ নির্দেশনা পাওয়া যায় ইসলাম ধর্মে। যেহেতু ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা।
ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে সুন্দর ও পবিত্র জীবনযাপনের জন্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যবস্থা করেছে। নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিয়ে হচ্ছে একমাত্র বৈধ উপায় এবং মানুষের চরিত্র ও সতীত্বকে রক্ষার হাতিয়ার। বিয়ের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পরস্পরের মধ্যে অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের অপরিহার্যতা আরোপিত হয়।
প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান হলে কালবিলম্ব না করে বিয়ে করা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব। বিয়ে শুধু জৈবিক চাহিদাই নয়, বরং একটি মহান ইবাদতও। বিয়ে দ্বারা ইহ ও পরকালীন কল্যাণ সাধিত হয়। বিয়ে মানুষের জীবনকে পরিশীলিত, মার্জিত এবং পবিত্র করে তোলে। আদর্শ পরিবার গঠন, জৈবিক চাহিদা পূরণ, মানসিক প্রশান্তি ও মানব বংশ বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম হলো বিয়ে।
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীর সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন (রুম-২১)।
আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন- তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের পোশাক এবং তোমরা (স্বামীরা) তাদের পোশাকস্বরূপ (বাকারা-১৮৭)। আল্লাহ আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করেনি, তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণ তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যারা বিয়েতে সামর্থ্য নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে, যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেন (নূর-৩২-৩৩)।
রাসুল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার সুন্নত তরিকা ছেড়ে চলবে, সে আমার দলভুক্ত নয়’ (বুখারি-৪৬৭৫)। ইসলামে বৈরাগ্যবাদে স্থান নেই। তাই মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত বিয়ে না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হতে পারে না। হাদিসে এসেছে- ‘যখন কোনো বান্দা বিয়ে করল, তখন সে তার ইমানের অর্ধাংশ পূর্ণ করল (মিশকাত)। ‘ইসলামে বৈরাগ্যতা নেই এবং বৈরাগ্য জীবনযাপন করাকে রাসুল সা. নিষেধ করেছেন (আবি শায়বাহ: ১০/৫)।
পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে সামাজিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে পরিবারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ইসলাম গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ তায়ালা পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করার লক্ষ্যেই পরিবারের প্রথম বিন্যাস বৈবাহিক চুক্তির পদ্ধতি চালু করেছেন, যা হজরত আদম ও হাওয়ার আ. এর মাধ্যমে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
পারিবারিক পদ্ধতির ব্যাপারে নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কি যথার্থই বলেছেন, ‘পরিবার হলো একটি গোষ্ঠী বা সংগঠন আর বিয়ে হলো সন্তান উৎপাদন ও পালনের একটি চুক্তিমাত্র।’ কারণ এ বিয়ের মধ্যেই নিহিত আছে মানবজীবনের পবিত্রতা ও সুস্থতা। ব্যক্তি ও পারিবারিক পবিত্রতা ও সুস্থতার ওপরই নির্ভর করে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বময় মানবজাতির পবিত্রতা ও সুস্থতা।
কুরআনের আয়াতদ্বয় থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, পারিবারিক বন্ধন থেকেই মানব বংশ সম্প্রসারণ হয়েছে। যদি সব জাতি ও গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তবে সে পরিবার সমাজে সর্বোত্তম আদর্শ পরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। যেখানে বইতে থাকে শান্তির ফল্কগ্দুধারা। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের বিচরণ হবে সুখকর ও আনন্দময়।
পরিবারের সদস্যরা যখন আল্লাহর দেয়া দায়িত্বানুভূতি সম্পর্কে সজাগ থাকবে, স্ত্রী তার অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে লাভ করবে। স্বামী যখন স্ত্রীর কাছে তার অধিকার পাবে, সন্তান বাবা-মায়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য ও তাদের অধিকার লাভ করবে, আত্মীয়-স্বজন যখন পরস্পরের যথাযথ সম্মান-মর্যাদা পাবে, তখন কোনো স্ত্রীর আর অসন্তোষ থাকবে না। কোনো স্বামী ভালোবাসা ও সুন্দর জীবনযাপনে অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হবে না, কোনো সন্তানই বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করবে না এবং আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কের দৃঢ়তায় আলল্গাহর রহমত, বরকত ও অনুগ্রহ বর্ষিত হতে থাকবে।
শুধু তাই নয়, ইসলাম নির্দেশিত পারিবারিক জীবন হলো আল্লাহ তায়ালার মহাঅনুগ্রহ। মানুষ আলল্গাহ প্রদত্ত পারিবারিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলে সমাজ থেকে নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতা এবং জীবনের শেষ সময়ে বৃদ্ধাশ্রমের মতো দুঃখী জীবনযাপন চিরতরে নির্মূল হবে। তাই একটি সুন্দর ও আদর্শ পরিবার গঠনের লক্ষ্যে আল্লাহ ও রাসুলের সা. নির্দেশনাগুলো মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানের অপরিহার্য দাবি।